দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বাংলাদেশে দিন দিন বাড়ছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যায় গড়ছে নতুন রেকর্ড। এই মুহূর্তে মৃত্যুর সংখ্যা কমা ছাড়া দেশের মানুষের জন্য কোনো সুখবর নেই। বরং বিশ্বে করোনা আক্রান্তের তালিকায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে।

এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের দিক দিয়ে বিশ্বে ৩৭তম স্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ। এমনই তথ্য দিচ্ছে করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী তথ্য দেওয়া ওয়ার্ল্ডোমিটার।

এদিকে করোনার এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় লন্ডনের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারের “নাইটিঙ্গেল হাসপাতাল” ও মাদ্রিদের আইএফইএমএ কনভেনশন সেন্টারের আদলে কনভেনশন সেন্টারকে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল।

এর আগে উহান শহরে দশ দিনে হাসপাতাল তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো চীনের কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঢাকার এই হাসপাতালটি হলো একুশ দিনে। অবকাঠামো অবশ্য আগেই বানানো ছিলো। শুধু বসানো হয়েছে শয্যা ও আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি।

বেসরকারি উদ্যোগ বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের জমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করতে দিলেও হাসপাতাল বানানোর মূল কাজটি করছে বাংলাদেশের সরকারই।

ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশে আইসিসিবি- ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার চারটি কনভেনশান সেন্টার এবং একটি প্রদর্শনী তাঁবুতে গড়ে উঠছে দেশের সবচেয়ে বড় এই কোভিড-১৯ হাসপাতাল।

বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর বিবিসিকে জানান, এই হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রায় আড়ই লক্ষ বর্গফুট জায়গা তারা সরকারকে অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে দিয়েছেন।

কী থাকছে এই হাসপাতালে:
অস্থায়ী হাসপাতালটি নির্মাণের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বিবিসিকে জানান, তিনটি কনভেনশন সেন্টার ও একটি প্রদর্শনী তাঁবুতে দুই হাজার তেরটি শয্যা পাতা হয়েছে।

তিনি বলেন- “এখানে আসলে আইসোলেশন করে রাখা হবে আর পোর্টেবল অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। দুই বেডের মাঝখানে আমরা বিদ্যুতের লাইন টেনে দিয়েছি ওখানে সকেট আছে।

কোন রোগীর যদি পোর্টেবল অক্সিজেন লাগে অথবা অন্য কিছু লাগে যাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যায় এবং ডাক্তাররা যেন তার রুমে বসে প্রত্যেকটা রোগীকে দেখতে পারেন তার জন্য সিসিটিভির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনিটরটা ডাক্তারের রুমে থাকবে উনি দেখতে পাবেন।”

দুই হাজারের বেশি শয্যা পাতা হলেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর জন্য জরুরি আইসিইউ ইউনিট ও ভেন্টিলেশন সুবিধা এখনো সংযোজন করা হয়নি।

তবে এসব সুবিধার জন্য বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের একটি ইউনিটে ৪৫ হাজার বর্গফুট জায়গা প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় এখনো এটি আটকে আছে, বলছেন কর্মকর্তারা।

চিকিৎসা শুরু হবে কবে?
১৪ই এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করে এরই মধ্যে দুই হাজারের বেশি শয্যা পাতা হলেও কবে থেকে রোগীদের সেবা দেওয়া হবে তা চূড়ান্ত হয়নি।

এই বিষয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর বিবিসিকে জানান, তারা সরকারকে তাদের কনভেনশন সেন্টারগুলো এবং এর সাথে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস পানি ইত্যাদি ব্যবহার করতে দিচ্ছেন। ডাক্তার, নার্স বা যন্ত্রপাতি এসবের ব্যবস্থা সরকার নিজে করবে।

সোবহান আনভীর বলেন- “আমাদের দায়িত্ব হলো, জায়গাটা দেওয়া, এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ’সহ সব ধরনের বন্দোবস্ত আছে। ডাক্তার, নার্স আর মেডিকেল যন্ত্রপাতি ছাড়া সবই আছে।” “ডাক্তার এবং নার্সের দায়িত্ব সরকারের এটা আমাদের দায়িত্ব না।”

ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী কতজন লাগবে?
অস্থায়ী হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য এরই মধ্যে একজন পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হাসপাতাল পরিচালনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

তবে এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান; দৈনিক আট ঘন্টা করে তিন ধাপে দায়িত্ব পালনের জন্য ৩১৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৬৩০ জন মেডিকেল অফিসার, ১২৬০ জন সিনিয়র নার্স ও ২৫২০ জন স্টাফ নার্সের জন্য চাহিদাপত্র প্রস্তুত করেছেন তারা।

চাহিদাপত্র অনুযায়ী ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য সেবাকর্মী পেলে তবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করা যাবে।

মহামারি শেষ হলে এই হাসপাতালের ভবিষ্যৎ কী?
সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, সামাজিক দায়িত্ব থেকেই তারা হাসপাতাল তৈরির জন্য সরকারকে জায়গা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের ২৬টি প্রতিষ্ঠান আছে যার প্রতিটি থেকে লাভ করি। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আয় না করলে কিছু হবে না।

তিনি বলেন, “দেখুন দুনিয়াতে এটা একটা সংকট চলছে এখন, একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব এ মূহুর্তে সরকারের সাথে একযোগে কাজ করা।

এটা খুবই জনবহুল একটা দেশ, যদি এটি (কোভিড-১৯) ভয়াবহ রূপ ধারণ করে তাহলে এটাকে সামলানোর মতো অবকাঠামো বাংলাদেশে নাই এখন পর্যন্ত। তাই আমরা চিন্তা করলাম, আমরা আমাদের কনভেনশান সেন্টারকে অস্থায়ী সেন্টার হিসাবে কেন ব্যবহার করিনা?”

করোনাভাইরাস মহামারী শেষে এই অস্থায়ী হাসপাতালকে তারা স্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরিত করবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সোবহান আনভীর বলেন, “দেখুন আমরা ব্যবসায়ী, কত ধরণের কত কিছু হতে পারে, এই বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিই নি। তবে অনেক কিছুই তো হতে পারে, তাই না?”

অন্যান্য দেশের কোভিড হাসপাতাল
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সর্ব প্রথম উহানে মাত্র দশ দিনে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল তৈরি করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় চীন। উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর গত ২৪শে জানুয়ারি এই হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

মূলতঃ ছোট ছোট কাঠামোকে জোড়া লাগিয়ে রাতারাতি এই হাসপাতাল তৈরি করে চীন। তবে মহামারি ধীরে ধীরে কমে আসায় মার্চের শেষের দিকে এসে অস্থায়ী এ হাসপাতাল বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার।

চীনের মতো রাতারাতি হাসপাতাল না বানালেও বেশ বড় আকারের দুটি কনভেনশান সেন্টারকে হাসপাতালে রূপান্তর করে করে ব্রিটেন এবং স্পেন। স্পেন মাদ্রিদের আইএফইএমএ কনভেনশন সেন্টারকে ২৫০টি আইসিইউ শয্যাসহ সাড়ে পাঁচ হাজার শয্যার অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরিত করে।

এ হাসপাতালটি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দিনে তিনশ’র নিচে নেমে আসার পর হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর চাপ সামলাতে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে এপ্রিল মাসের শুরুতে লন্ডনের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারকে ‘নাইটিঙ্গেল হাসপাতাল’ নামে চার হাজার শয্যার অস্থায়ী একটি হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়।

উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮ লাখ ২২ হাজার ৯৫১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ লাখ ৯ হাজার ২৯৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আর এই ভাইরাসে আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত মৃত হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৮৪ জনের।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৭২ জনের মধ্যে ২২ লাখ ৬ হাজার ৬৬৭ জন স্থির অবস্থায় রয়েছেন। এছাড়া, ৪৮ হাজার ২০৯ জন গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন, যা মোট রোগীর মাত্র দুই শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশে একদিনে নতুন করে এ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ৭৯০ জন করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে বুধবার (০৬ মে) পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭১৯ জনে। আর মোট মৃত্যু হয়েছে ১৮৬ জনের।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০৭মে, ২০২০)