দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের রহস্যজনক মৃত্যুকে ঘিরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন বেরিয়েছে। একইসঙ্গে অন্তর্জালে ঘুরছে নানান মন্তব্য ও শোক। মুম্বাই মিরর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টার বিবরণ। এরপরই মাত্র ৩৪ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে দাড়ি বসিয়ে দিয়েছেন তিনি, অকালে চলে গেছেন অনন্তযাত্রায়।

মুম্বাই মিররের প্রতিবেদন বলছে, মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় কার্টার রোডের একটি ভবনের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে রবিবার (১৪ জুন) ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে দিন শুরু করেন সুশান্ত। এরপর প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে সময় কাটছিল। সকাল ৯টায় ফোন করেন বোনকে।

হৃদয়বিদারক ঘটনাটির টাইমলাইন
সকাল ৯টা ৩০ মিনিট: জুসের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন সুশান্ত।
সকাল ১০টা ৩০ মিনিট: দুপুরের খাবারের বিষয়ে জানতে দরজায় নক করেন গৃহকর্মী। কিন্তু কোনও সাড়া মেলেনি।
দুপুর ১২টা: গৃহকর্মী আবারও দরজায় নক করেন। কিন্তু কোনও জবাব আসেনি। এরপরই শঙ্কা জাগে তার মনে।
দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট: সুশান্ত সিং রাজপুতের বোনকে বিষয়টি জানানো হয়।
দুপুর ১২টা ৫০ মিনিট: বোন এসে দরজা খোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও শব্দ পাওয়া যায়নি।
দুপুর ১টা ১৫ মিনিট: তালা খুলতে মিস্ত্রি ডেকে আনা হয়। চাবি বানিয়ে দরজা খুলতেই সুশান্ত সিং রাজপুতের দেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায় কক্ষের ভেতর।

বিছানার চাদর দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন সুশান্ত সিং রাজপুত। এ ঘটনায় তার ঘরের দুই গৃহকর্মী ও হাউসকিপারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের দাবি, কিছুদিন ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন সুশান্ত। এছাড়া প্রতিবেশী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ।

সুশান্তের প্রস্থানে সারাভারত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। তার আত্মহত্যা স্তব্ধ করে দিয়েছে বলিউডকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক জানিয়ে চলেছেন ক্রীড়াঙ্গনের তারকারাও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিভাবান এই অভিনেতার মৃত্যুতে বিষণ্ন হয়ে টুইট করেছেন। নৃত্য পরিচালক রেমো ডি’সুজা জানিয়েছেন, সুশান্তের সঙ্গে নাচনির্ভর একটি ছবিতে কাজ করার ব্যাপারে আলোচনা চলছিল তার।

নভেম্বরে বিয়ের জন্য চলছিল প্রস্তুতি
সুশান্তের এক কাজিন ভারতের একটি নিউজ পোর্টালকে জানিয়েছেন, আগামী নভেম্বরে বিয়ে করার কথা ছিল তার। মুম্বাইয়ে ঘরোয়া পরিসরে সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তিনি। যদিও পাত্রীর নাম উল্লেখ করেননি ওই কাজিন।

বলিউড অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে সুশান্তের সম্পর্কের গুঞ্জন চলছিল অনেকদিন ধরে। সোমবার (১৫ জুন) ড. আরএন কুপার মিউনিসিপ্যাল জেনারেল হাসপাতালে তাকে শেষবার দেখতে এসেছিলেন রিয়া। সুশান্তের লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আত্মহত্যাই করেছেন সুশান্ত। ঝুলে থাকায় অ্যাসপিক্সিয়ার (অক্সিজেনের ঘাটতিতে দম বন্ধ হওয়া) কারণে মারা গেছেন তিনি। যদিও পুলিশ কোনও সুইসাইড নোট পায়নি। তবে ফ্ল্যাটে প্রেসক্রিপশন ও অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ মিলেছে। তার শরীরে কোনও বিষ রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা হবে জেজে হাসপাতালে। এছাড়া রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য সংরক্ষণ করা ভিসেরার নমুনা ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠাবে মুম্বাই পুলিশ।

সোমবার কুপার হাসপাতালে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আরও এসেছিলেন সুশান্তের ‘রাবতা’ ছবির নায়িকা কৃতি স্যানন, ‘ছিচোরে’র সহশিল্পী শ্রদ্ধা কাপুর, প্রথম ছবি ‘কাই পো চে!’র সহশিল্পী রাজকুমার রাও, ‘সঞ্চিরিয়া’র সহশিল্পী রণবীর শোরে, অভিনেতা বিবেক ওবেরয়, জ্যাকি ভাগনানি, প্রযোজক দিনেশ বিজন, মুক্তি প্রতীক্ষিত ‘দিল বেচারা’ ছবির পরিচালক মুকেশ ছাবরা, ‘কাই পো চে!’ ও ‘কেদারনাথ’ ছবির পরিচালক অভিষেক কাপুর।

এতো কাকতালীয়!
গত ৮ জুন সুশান্তের সাবেক ম্যানেজার দিশা সালিয়াঁ মুম্বাইয়ের মালাডে একটি ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় ইনস্টাগ্রাম স্টোরিসে শোক জানিয়েছিলেন সুশান্ত। ছয় দিনের ব্যবধানে প্রায় একইভাবে নিজের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিলেন তিনি। তার স্বজনরা বলছেন, এ দুটি ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে না। তারা সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এমন প্রাণবন্ত একটা ছেলে আত্মহত্যা করবে তা মানতে নারাজ পরিবার। তারা এর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজছেন। মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চ ইতোমধ্যে সুশান্তের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে।


আত্মহত্যার আগে বোন ও বন্ধুকে ফোন

রবিবার সকাল ৯টায় বোনকে ফোন করেছিলেন সুশান্ত। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। এরপর জুস নিয়ে ঘরে ঢুকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহেশ শেঠিকে ফোন দেন তিনি। জিটিভির জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘পবিত্র রিশতা’য় একসঙ্গে অভিনয় করেছেন তারা। এর আগে স্টার প্লাসের ‘কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল’ সিরিয়ালেও দেখা গেছে তাদের। এর মাধ্যমে ছোট পর্দায় অভিষেক হয় সুশান্তের। গত মাসে মহেশের জন্মদিনে তার সঙ্গে তোলা একটি সেলফির মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানান সুশান্ত। জানা গেছে, সুশান্তের মৃত্যুর তদন্তের অংশ হিসেবে রিয়া চক্রবর্তী ও মহেশ শেঠির বক্তব্য রেকর্ড করবে পুলিশ।

তিন দিন আগে বাবাকে শেষ ফোন
তিন দিন আগে বাবা কেকে সিংয়ের কাছে ফোন করেছিলেন সুশান্ত। তার স্বাস্থ্যের খবর নিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ঘরের বাইরে যেতে বারণ করেছেন। বাড়ির গৃহকর্মী লক্ষ্মী দেবীকে ফোনে তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য দয়া করে আমার বাবার অনেক যত্ন নেবেন।’ এটাই যে ছেলের সঙ্গে শেষ আলাপ হবে তা বুঝতে পারেননি বাবা। রবিবার দুপুরের খাবার খেতে বসার পর মুম্বাই পুলিশের ফোন পেয়ে সব জানতে পারেন এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। খবরটা শুনেই কেকে সিং অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

সুশান্তের শৈশব কেটেছে বিহারের পাটনায়। সেন্ট কারেন’স হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। দুঃসংবাদ শুনে অনেকে তাদের বাড়িতে জড়ো হন। সবার মন্তব্য, ‘সুশান্ত ছিলেন বিহারের গর্ব।’ ২০০২ সালে মায়ের মৃত্যুর পর দিল্লি এসে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর শোবিজে যুক্ত হন।

সোমবার (১৫ জুন) মুম্বাইয়ের ভাইল পার্লে শ্মশানে সুশান্তের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এজন্য বিহারের পাটনা থেকে এসেছেন বাবা ও পরিবারের সদস্যরা। মুম্বাইয়ে তখন বৃষ্টি ঝরছিল। হয়তো হাসিখুশি ছেলেটা চিরশান্ত হয়ে যাওয়ায় কাঁদছিল আকাশ!
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়া টিভি নিউজ, হিন্দুস্তান টাইমস, বলিউড হাঙ্গামা, টাইমস অব ইন্ডিয়া

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/১৬জুন, ২০২০)