দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ‘আমাকে দশটা কাঠের টুকরো আর একজন জিনেদিন জিদান কে এনে দেও, আমি তোমাদের চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা এনে দিব’- ফুটবলার জিদানের সম্পর্কে বলেছিলেন স্যার এ্যালেক্স ফার্গুসন। আলজেরিয়ার জন্ম নেয়া জিদানকে মনে করা মর্ডান ফুটবলের সর্বকালের সেরা ফুটবলার মনে করা হয়। মিডফিন্ডে একজন জিদান থাকা মানে খেলার ধরন বদলে যাওয়া, পায়ের ফুটবলটা ছিল এক শৈল্পিক নিদর্শন। ব্যক্তিগত অর্জন বা গোল-এসিস্টের হিসেবের থেকেও উর্ধ্বে থাকা এই কিংবদন্তী নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে জিতেছেন সকল কিছু। তবে আক্ষেপটা সমাপ্তিতে। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানার আগে এমনকিছুই জিদান করে ফেলেন যা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি কেউ।

‘আমি জিদানের কাছে ফিরে গেলাম। দেখলাম জিদান তার বাহু থেকে অধিনায়কের ব্যাচ টা খুলে ফেলেছেন। জিদান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি জানি কীনা কি ঘটেছে। আমি বললাম, না, আমরা কেবল দেখেছি আপনি কেবল গুতো মারছেন। আমি জিদানকে বললাম, কি ঘটেছে আমাকে বলুন। তিনি আমাকে কিছুই বললেন না। তিনি ঘুরে দাড়িয়ে মাঠের বাইরে হাঁটা দিলেন।’- ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদানকে লাল কার্ড দেখানোর পর ঐ ম্যাচের রেফারি হোরেশিও আলেজান্দ্রো।

ফাইনাল ম্যাচের আগেই গোল্ডেন বল বিজয়ী হিসেবে জিদানের নাম ঘোষণা করা হয়। ফেভারিট হিসেবেই ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে নামে ফ্রান্স। দলের সবথেকে বড় তারকা জিনেদিন জিদানের শেষ ম্যাচ। ফাইনাল শুরুর মাত্র ৭ মিনিটের মাথায় ফ্রান্সকে এগিয়ে দেয় জিদান। তবে এতকিছুর পরও ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা বললেই চলে আসে ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জিকে মারা জিদানের সেই ঐতিহাসিক ঢুসের কথা। লাল কার্ড পেয়ে ম্যাচের ১১০ তম মিনিটে মাঠ ছাড়েন জিদান।

অতিরিক্ত সময়েও ১-১ এ সমতা থাকা ফাইনালের ট্রাইব্রেকারেও অংশগ্রহণ করতে পারেননি তিনি। ৫-৩ এ পরাজিত হয় জিদান বিহীন ফ্রান্স। মাতেরাজ্জিকে ঢুস মারার দায়ে ফিফা পরবর্তীতে ৩ ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা দেয় জিদানকে। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটিতে এমন নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় সে শাস্তি যদিও আর কখনোই ভোগ করতে হয়নি আধুনিক ফুটবলের এই অন্যতম মহান খেলোয়াড়কে তবে বাকি জীবন হয়তো নিজে নিজেই বয়ে বেড়াবেন ছেলেমানুষি আবেগের কারণে ২০০৬ বিশ্বকাপটি হারানোর যন্ত্রণা।

অনেকেরই ধারনা ট্রাইব্রেকার পর্যন্ত জিদান থাকলে ইতিহাস অন্যরকমও হতে পারত। সেই ধারণার পেছনে অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। কারণ দলের সবথেকে সেরা খেলোয়াড় এবং একইসাথে দলের অধিনায়ক যখন এমন এক পরিস্থিতিতে দলকে রেখে উঠে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটি বড় চাপের ভেতর এসে পড়ে গোটা দল। আর সেই চাপটাই ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জয় থেকে বঞ্চিত করে দেয়।

তবে বিশ্বকাপ বঞ্চিত হলেও জিনেদিন জিদানের মহত্ব অবশ্য একটুকু কমেনি। ফুটবল কিংবদন্তী হিসেবেই ফুটবলকে বিদায় জানানো জিদান অবশ্য পরে ফিরেছেন অন্য এক রূপে। ২০১০ সালে রিয়াল মাদ্রিদের ‘স্পেশাল এডভাইসার’ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া জিদানের কাজ ছিল দলের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচগুলোতে কাজ করা। ২০১৩ তে সহকারী কোচ আর ২০১৪ তে রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দল কাস্তিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

২০১৬ সালে টানা ব্যর্থতার ঘূর্ণিপাক খেতে থাকা ভাঙাচোরা রিয়াল মাদ্রিদের কোচের দায়িত্ব থেকে সরে যায় রাফায়েল বেনিতেজ। সহকারী কোচ থেকে জিজু চলে আসেন মূল দায়িত্ব, চুক্তি হয় আড়াই বছরের। মৌসুমের মাঝপথে দায়িত্ব নেওয়া জিদান প্রথম ম্যাচেই রিয়ালকে এনে দেন ৫-০ গোলের বিশাল জয়। ভাঙা দল নিয়েই ২০১৬ সালের ২৮ মে চ্যাম্পিয়নস লিগ (লা ডেসিমা) জেতার এক অসাধ্য সাধন করে দেখান। এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালকে টানা তৃতীয়বারের মতো শিরোপা জিতিয়ে এই শিরোপাকে ডালভাতে রূপান্তরিত করেছেন এই টেকো মাথার জাদুকর।

১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে লিও বেনহ্যাকারের রিয়াল মাদ্রিদ টানা ৩৪ ম্যাচ অপরাজিত থাকার ক্লাব রেকর্ড গড়েছিলেন, জিনেদিন জিদানের অধীনে থাকা এ দল টা নিজেদের এ রেকর্ড টপকিয়ে বার্সার গড়া স্প্যানিশ রেকর্ড টাও ভেঙ্গে দিয়েছিলো। কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম বছরেই জিতেছিলেন ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা, প্রথম ১৭ মাসে মূল্যবান ৫ টি শিরোপা।

লা-লীগা উদ্ধার করেছিলেন, প্রথম দল হিসেবে রিয়ালকে টানা ২ টি চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতিয়েছেন, নিজেও কোচ হিসেবে সবচেয়ে কম সময়ে ২টি চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন, ইতিহাসের সপ্তম জাদুকর হিসেবে কোচ ও ফুটবলার উভয় ভুমিকাতেই ইউসিএল জেতা এই লোকটার অধীনে টানা সবচেয়ে বেশী ম্যাচে গোল করেছে রিয়াল মাদ্রিদ।

তবে জয়রথ টা সেখানেই থামাননি, প্রথম ফুটবল দল হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লীগে টানা ৩ বার শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে এই টেকো মাথার লোকটার অধীনেই ভালো খেলোয়াড় নাকি ভালো কোচ হতে পারেন না, বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ টাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন একজন জিদান। খেলোয়াড়, কোচ- উভয়ক্ষেত্রে সমান পারদর্শী হয়ে জিনেদিন জিদান নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। এই কিংবদন্তী আজ পা দিয়েছেন ৪৮ তম বয়সে। শুভ জন্মদিন জিনেদিন জিদান।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২৩জুন, ২০২০)