সতর্ক করেছিলেন বিজেপির জনপ্রতিনিধি
লাদাখে অনেক আগেই ঢুকেছে চীন,নিষ্ক্রিয় থেকেছে ভারত
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক, ১১ জুন বেলা ১১ টা ৭ মিনিট। তখনও গালওয়ানের চীনা বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় ফৌজের সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেনি। তার চার দিন আগে ঠিক ওই সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেন উরগেন শোদন।
ওই দিনই বেলা ১১টা ৪৯ মিনিট থেকে দুপুর ২টো ৫৮ মিনিটের মধ্যে আরও পাঁচটি পোস্ট করেন উরগেন। প্রতিটি পোস্টেই ছবি এবং ভিডিও-সহ উল্লেখ করা হয়েছে, মাসের পর মাস ধরে কী ভাবে চীনা বাহিনী ভারতের নাকের ডগায় একটু একটু করে ভারতীয় ভূখন্ডে নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে চীনের অধিকার কায়েম করেছে। কিন্তু নিষ্ক্রিয় থেকেছে ভারত।
উরগেনের বাড়ি লাদাখের নায়য়োমা গ্রামে। সিন্ধু নদের তীরে পাহাড়ে ঘেরা একটা ব্লক। যার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি)। লেহ্ থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে বরফে ঢাকা ধূসর পাথুরে এই অঞ্চলে মূলত তিব্বতি জনজাতির বিভিন্ন যাযাবর গোষ্ঠীর বাস। যাঁদের মূল পেশা পশুপালন।
উরগেনও সেই রকমই একটি যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ। লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার আগে তিনি ছিলেন পঞ্চায়েত প্রধান। এখন বিজেপির টিকিটে জিতে আসা নায়য়োমা ব্লক উন্নয়ন পর্ষদের সভানেত্রী।
সেই উরগেন পোস্ট করলেন, ‘‘গালওয়ানে যা চলছে তা নতুন কোনও ব্যাপার নয়। আর এ সমস্তটাই হচ্ছে সীমান্ত এলাকা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা না থাকার জন্য। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নেই কোনও সঠিক পরিকল্পনাও।”
গালওয়ান সংঘর্ষের চার দিন আগে এটাই ছিল উরগেনের প্রথম পোস্ট।
গালওয়ানে তখনও সরাসরি সেনা সংঘাতের ঘটনা না ঘটলেও, যে দিন উরগেন ওই পোস্ট করেছেন, তার আগে থেকেই গালওয়ানে দুই সেনার অবস্থান ঘিরে পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সেই পরিস্থিতি প্রসঙ্গেই ওই দিনের এই পোস্ট।
একটি পোস্টে ছবি-ভিডিও দিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের মে মাসে কী ভাবে প্রায় ১৫০ ভারী মেশিনপত্র নিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর রাস্তা বানিয়েছে চিনা সরকার। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সারি সারি চীনা লরি, মাটি কাটার বড় বড় জেসিবি মেশিন-সহ রাস্তা তৈরি করার ভারী যন্ত্রপাতি কাজ করছে প্রকাশ্যেই। ছবিটি নিয়ন্ত্রণরেখার লাগোয়া ফুঙগাপ গ্রামের বলে জানানো হয়েছে ওই পোস্টে। উরগেন প্রশ্ন তুলেছেন, বিনা বাধায় কী ভাবে নিয়ন্ত্রণরেখার গায়ে এ ভাবে রাস্তা তৈরি করছে চীন? পরের পোস্টেই ডিসেম্বরে কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই রাস্তার ছবি পোস্ট করেছেন উরগেন। ঝকঝকে মসৃণ রাস্তা।
এর পরেই উরগেন গত বছর ৬ জুলাইয়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর আগের বছরের পোস্টের ছবি দিয়ে জানিয়েছেন, “সবাই সাবধান হোন। আমাদের দেশের জন্য উদ্বেগের খবর। ৬ জুলাই ২০১৯, ডেমচক, কোয়ুল দুংটি এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এক জায়গায় হয়ে দলাই লামার জন্মদিন পালন করি। আমরা সেই উৎসবের অংশ হিসাবে ভারতের জাতীয় পতাকা, বৌদ্ধ পতাকা এবং তিব্বতের পতাকা উত্তোলন করি। এই বছরও তা করি। তার পরেই চীনা বাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার আমাদের ভুখণ্ডের মধ্যে ঢুকে আসে। এসে আমাদের শাসায়। কেন আমরা পতাকা উত্তোলন করেছি। আমার প্রশ্ন, চীনাদের সাহস কী করে হয় আমাদের মাতৃভূমির মধ্যে ঢুকে আমাদের শাসানোর? এটা ওদের দখলদারির ছক। ওরা আমাদের জমি দখল করতে চাইছে। বংশ পরম্পরায় আমাদের পশুপালনের যে চারণভূমি, তা দখল করে নিতে চাইছে চীনারা। আমি দেশের এবং এই এলাকার সমস্ত নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি গোটা বিষয়টা নিয়ে। কারণ চীন ক’দিন আগেই নিয়ন্ত্রণরেখায় রাস্তা বানিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি হচ্ছে।”
উরগেন গত বছরের সেই পোস্ট ট্যাগ করে, গত ১১ জুন আর একটি পোস্টে সেই ঘটনার সঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘‘গত বছর ডিসেম্বর মাসে চীনারা ওই জমি নিজেদের বলে দাবি করে এবং আমাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। আমাদের চারণভূমি থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেয় চীনা বাহিনী।” উরগেনের পোস্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, চীনা বাহিনী চীনের জাতীয় পতাকা পুঁতে পাহারা দিচ্ছে। উরগেনের দাবি, ওই জমি আগে ভারতেরই ছিল।
এ বছর ১১ জুন উরগেনের পোস্ট। ছবি দিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, চীনা বাহিনী কুকুর দিয়ে পশুপালকদের তাড়া করছে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে।
এর পরের পোস্টেই তিনি ছবি দিয়ে দাবি করেছেন, কী ভাবে নিজেদের পশুপালন ক্ষেত্র থেকে পঞ্চাশ গজ পিছনে সরে আসতে হয়েছে ওই এলাকার মানুষদের। ওই ১১ জুনেই উরগেনের শেষ পোস্ট। সেখানে তিনি ছবি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, ‘‘এ বছর জানুয়ারি মাসে আমরা আমাদের পশুপালনের জমিতে পশু নিয়ে গেলে চীনা সেনা প্রশিক্ষিত কুকুর বাহিনী নিয়ে মেষ এবং ইয়াক পালকদের তাড়া করে সরিয়ে দেয়। পশুপালকদের শাসায়, তাঁরা ওই জমিতে গেলে তাঁদের ধরে নিয়ে যাবে চীনা বাহিনী।”
এর আগে এ বছর এপ্রিল মাসেও তিনি নিয়ন্ত্রণরেখায় চীনা সৈন্যবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় বিভিন্ন মহলের চাপে সেই পোস্ট তিনি মুছে দেন। তিনিই ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসাবে প্রথম চীনা অনুপ্রবেশ নিয়ে সতর্ক করেন বিভিন্ন মহলকে।
সুত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, (দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম,২৮ জুন ২০২০)