সাহেদের নিরাপদ বাহন ছিল ট্রাক
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য টানা দশদিন ভাসমান অবস্থায় ছিল রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ। এই ঘোরাঘুরিতে তার নিরাপদ বাহন ছিল ট্রাক ও প্রাইভেট কার। পালিয়ে থাকা অবস্থায় গত ৯ জুলাই রাতে সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ট্রাকে ঢাকায় আসে। এরপর আবার ঢাকা থেকে প্রাইভেট কার যোগে বের হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিতে বার বার গাড়ি পরিবর্তন করতো সাহেদ।
বুধবার (১৫ জুলাই) ভোরে সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে র্যাবের একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে মোহাম্মদ সাহেদকে। অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক র্যাব কর্মকর্তা এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘৭ জুলাই রাতে সাহেদ নিজের গাড়ি নিয়ে নরসিংদী চলে যায়। নরসিংদী থেকে কুমিল্লা। ৮ জুলাই সারাদিন ওই এলাকায় ছিল। সেখান থেকে ৯ জুলাই একটি বেসরকারি কোম্পানির ট্রাকে ঢাকায় আসে। ঢাকায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখে ফের ঢাকা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে। এরপর রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজের ভায়রা গিয়াসের প্রাইভেট কারে করে কাপড়চোপড় নিয়ে মানিকগঞ্জ চলে যায়। মানিকগঞ্জ থেকে একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে মহেশখালী যায়। মহেশখালীতে সাহেদ একটি সাইক্লোন সেন্টার তৈরি করে দিয়েছিল, সেখানে তার পরিচিত লোকজনের কাছে আশ্রয় চাইতে গিয়েছিল। সেখানে আশ্রয় না পেয়ে সাতক্ষীরা যায়। এরমধ্যে সে সাতক্ষীরার মাফিয়া ও ভারতে মানুষ পারাপারকারী বাচ্চু মাঝির সঙ্গে যোগাযোগ করে। বাচ্চুর সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতে পারাপারের বিষয়ে। বাচ্চু তাকে বর্ডার পার করে দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়। ১১ জুলাই সাতক্ষীরা যায় সাহেদ। সেখানে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকার চেষ্টা করে। তবে কেউ তাকে জায়গা দেয়নি। এক খালু বাড়িতে গেলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তিনদিন সে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিল। সে বেশিক্ষণ কোনও বাড়িতে অবস্থান করেনি।’
সাতক্ষীরার এই একই পথ দিয়ে ২০০৮ সালে এমএলএম ব্যবসায় প্রতারণা করে ভারতে পালিয়ে ছিল সাহেদ। তিই সাতক্ষীরার এই সীমান্ত এলাকা সাহেদের খুব পরিচিত।
গ্রেফতারের সময় আলো আধারে সাহেদ ছিল আতঙ্কিত
র্যাব যখন সাহেদকে সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করে, তখন সে খুব আতঙ্কিত ছিল। তাকে পারাপারকারী মাঝি বাচ্চু পালিয়ে গেলেও সাহেদ পালাতে পারেনি। র্যাব তাকে গ্রেফতারের পরেই সে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। কয়েকবার কান্নাকাটিও করে। র্যাব সদস্যদের হাত পা ধরা শুরু করে।
স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো সাহেদ
র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাহেদ তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। ভারতে যাবার বিষয়টিও তার পরিবারকে জানিয়েছিল। ভারত পালিয়ে যেতে পারলে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার আশ্বাসও দিয়েছিল সাহেদ। পুরো বিষয়টি র্যাবের গোয়েন্দা টিম মনিটরিং করেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে টাকা পাচার করেছে
অবৈধভাবে আয় করা সাহেদ তার অর্থের মোটা অংক হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। সে ব্যাংকে বেশি টাকা জমা রাখতো না।
২০ বছর ধরে প্রতারণা করছে সাহেদ
সাহেদ ২০০০ সাল থেকে প্রতারণা করছে। এসব প্রতারণা করতে গিয়ে জেল খেটেছে খুবই কম। প্রথমে নিজের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে বাইরের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে। পদ্মা সেতু সহ বিভিন্ন সরকারি প্রজেক্টের ইট, বালু, সিমেন্ট সরবরাহ করতো সাহেদ। এসব প্রকল্পে অন্যদের চেয় কম টাকায় এসব সামগ্রী সরবরাহ করতো। কারণ সে যাদের কাছ থেকে ইট, বালু ও পাথর নিতো তাদের এসব সামগ্রী সরবরাহ করার পর জাল স্বাক্ষরের চেক দিত। সেই চেক দিয়ে কেউ কখনও টাকা তুলতে পারেনি। টাকা চাইতে গেলে পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন হুমকি দিতো। এমনকি বলতো চেক চুরি করে নিছো। মামলা করবো। এই চেকে স্বাক্ষর আমার না।
এমএলএম ব্যবসায় জেল খাটার পর নাম পরিবর্তন
সাহেদ ২০০৮ সালে এমএলএম ব্যবসায় জেল খাটার পর জামিনে বের হয়ে তার নাম, জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে। আগে তার নাম সাহেদ করীম থাকলেও জেল খাটার পর সে হয়ে যায় মোহাম্মদ সাহেদ। পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্সে সকল তথ্য পরিবর্তন করে ফেলা হয় বলে জানিয়েছে র্যাব।
বুধবার (১৫ জুলাই) ভোরে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় আনার পর সাহেদ ও রিজেন্টের এমডি মাসুদকে নিয়ে উত্তরায় একটি বাসায় অভিযানে যায় র্যাব। সেখানে রিজেন্ট গ্রুপের এক কার্যালয় থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার জাল টাকা উদ্ধার করে। এরপর র্যাব বিকাল ৩ টায় সংবাদ সম্মেলন করেন। সাহেদকে বিকালেই ডিবিতে হস্তান্তর করে র্যাব।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/১৬জুলাই, ২০২০)