কারখানা শ্রমিক যখন গোল্ডেন বুট বিজয়ী
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: গত ২৬ জুলাই রাতে পর্দা নেমেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯-২০ মৌসুমের। স্বভাবিকভাবেই এই মৌসুমটা হৃদয়ের গভীরে থাকবে লিভারপুল সমর্থকদের। কারণ ৩০ বছরের অপেক্ষা শেষে এবারই তো তাঁরা জিতেছে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা।
তবে শুধু লিভারপুল সমর্থকদের কাছে নয়, এই মৌসুমটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরো একজনের কাছে। তিনি আর কেউ নন, লিচেস্টার সিটির তারকা ফরোয়ার্ড জেমি ভার্ডি। কারণ এই মৌসুমেই ভার্ডি প্রিমিয়ার লিগের বাঘা বাঘা সব তারকাদের পেছনে ফেলে জিতে নিয়েছেন সর্বোচ্চ গোল দেওয়ার পুরষ্কার। আর যখন এই অর্জন জিতলেন তখন ভার্ডির বয়স ৩৩, লিগ ইতিহাসে এত বুড়ো বয়সে প্রিমিয়ার লিগে গোল্ডেন বুট জেতার নজির দেখাতে পারেনি কেউ। তবে জেমি ভার্ডির এই অর্জনের পেছনের পথটা মসৃণ ছিলনা। স্বপ্ন পূরণের পথটা পাড়ি দিতে ভার্ডিকে দেখতে হয়েছে নানান চড়াই-উতরাই।
১৯৮৭ সালের ১১ ই জানুয়ারি এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। বাবা ছিলেন একজন ক্রেন ড্রাইভার, আর মা কাজ করতেন ‘লিগ্যাল সেক্রেটারি’ হিসেবে। দিনের বেশিরভাগ সময়-ই ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকতো বলে সে পড়াশোনায় খুব বেশি অমনোযোগী ছিলো। ১৬ বছর বয়সের বালকটি চেয়েছিলো শহরতলীর স্থানীয় ‘শেফিল্ড উইডন্যসডে’ ক্লাবে খেলতে। কিন্তু তাকে বাতিল করে দেয়া হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ ভালো না থাকার কারণ দেখিয়ে!
এরপর তাঁর জীবনে নেমে এসেছিলো আরো ভয়াবহ দুঃসময়। বাবা-মা তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং নিজের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য বলেন। অভিভাবকহীন ছেলেটা তখন নিজের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখতে এখানে সেখানে ছোটখাটো চাকরি খুজতে থাকলো। এবং এক সময় একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করলো। কিন্তু ফুটবল নেশাগ্রস্থ কোনো মানুষ যে ফুটবল ছাড়া বাঁচতে পারেনা- এমন ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো।
ছেলেটা কাজের পাশাপাশি সময় পেলেই ফুটবল অনুশীলন করতে থাকলো এবং একসময় স্থানীয় ‘স্টকব্রীজ পার্ক’ দলে খেলার সুযোগ পেলো। তাঁর স্কিলগুলো যথেষ্ট উচ্চমানের ছিলো বলে সবার প্রসংশা কুড়াতে থাকলো সে। সপ্তাহে মাত্র ৩০ পাউন্ডের বিনিময়ে সে সেখানে খেলা চালিয়ে যেতে থাকলো, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৩ হাজারের মতো!
মাত্র ৯ বছর আগেও জেমি ভার্ডি খেলতেন নন-প্রফেশনাল লীগে। আর ২০১২ সালের মে মাসে জেমি ভার্ডির জীবনে ঘটে যায় বিস্ময়কর একটি ঘটনা। একজন নন- লীগ ফুটবলার`কে দলে ভেড়ানোর জন্য ইংলিশ ক্লাব লিচেষ্টার সিটি খরচ করে ১ মিলিয়ন ডলার! তখনকার জেমি ভার্ডির জন্য মূল্যেটা তখন মোটেও কম ছিলোনা। কারখানার শ্রমিক থেকে লিচেষ্টারের কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাস- যাত্রাটা তখন কেবল শুরু!
লিচেষ্টারের হয়ে ১ম মৌসুমটা একদম ই ভালো কাটেনি ভার্ডির৷ পুরো মৌসুমে তার পা থেকে আসে মাত্র ৫ টি গোল! ক্লাব ম্যানেজমেন্ট পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ে ভার্ডির উপর। ক্লাবের ফ্যানরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে কটাক্ষ এবং ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে! বিদ্রুপের পরিমান এতোটাই প্রবল ছিলো যে, জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো ভার্ডি ফুটবল খেলা ছেড়ে দেয়ার কথাও ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ক্লাবের তৎকালীন ম্যানেজার নাইজেল পিয়ারসন এবং সহকারী ম্যানেজার ক্রেইগ শেক্সসপিয়ার তাঁর পাশে দাঁড়ান এবং খেলা চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেন।
২০১৩-১৪ মৌসুমে ভার্ডি ক্লাবের নির্ভরযোগ্য একজন ফুটবলারে পরিণত হন। লোকাল রাইভাল দল ডার্বি কাউন্টিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে লিচেষ্টার সিটি লীগ টেবিলের শীর্ষে উঠে আসে। মৌসুমে ১৬ গোল করে জেমি ভার্ডি তার ক্লাবকে লীগ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রিমিয়ার লীগে প্রমোট করতে সাহায্য করেন। সে মৌসুমে লিচেষ্টারের ‘প্লেয়ার্স প্লেয়ার অব দ্যা সিজন’ নির্বাচিত হন জেমি ভার্ডি।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ভার্ডির মার্কেট প্রাইস ২.১ মিলিয়ন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ মিলিয়নে! ফেব্রুয়ারিতে ভার্ডি লিচেষ্টার সিটির হয়ে নতুন চুক্তি করেন যেখানে তাঁর সপ্তাহিক স্যালারি ছিলো £৮০,০০০ ডলার বা $১১৩,০০০ পাউন্ড! সপ্তাহিক ৩০ পাউন্ডে ক্যারিয়ার শুরু করা ভার্ডির সপ্তাহিক আয় তখন আশি হাজার ডলার। অবশ্য সেই মৌসুমে নিজের যোগ্যতার প্রমাণটাও বেশ ভালোভাবে দিয়েছিলেন। ৩৬ ম্যাচে ২৪ গোল আর ৬ এসিস্ট করে লিচেস্টার সিটির ১৩৬ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইপিএলের স্বাদ দেওয়ায়। এরপর ভার্ডির কাছে বেশ কিছু বড় ক্লাবের প্রস্তাব আসলেও জীবনে নানান চড়াই-উতরাই দেখা ভার্ডি থেকে যান লিচেস্টারেই। হয়তো গোল্ডেন বুটের আক্ষেপ মেটানোর জন্যেই থেকে গিয়েছিলেন।
সেই আক্ষেপ মিটেছে এবার, আগুয়েরো, সালাহ, মানে কিংবা অবামেয়াংদের মতো খ্যাতনামা ফুটবলারদের পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ গোলের পুরষ্কারটা জিতেছেন ভার্ডি। তাও কিনা ৩৩ বছর বয়সে! সবথেকে বয়স্ক ফুটবলার হিসেবে ইপিএলের গোল্ডেন শ্যু জয়ের রেকর্ডটাও এখন ভার্ডির দখলে। সেই ভার্ডি যে কিনা তাঁর জীবনে দুইবার চেয়েছেন ফুটবল ছেড়ে দিতে! সেই ভার্ডি জীবীকার জন্যে যাকে কাজ করতে হয়েছে কারখানাতে!
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২৮জুলাই, ২০২০)