খুলনার ‘ফাটা কেস্ট’ সাম্রাজ্যের পতন
খুলনা প্রতিনিধি: মোস্তফা কামাল ওরফে মিনা কামাল (৫৫)। রূপসার অপরাধ জগতের 'মুকুটহীন সম্রাট'। ‘ফাটা কেস্ট’ নামেই বেশি পরিচিত। খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তার বিরুদ্ধে ৯ হত্যা-চাঁদাবাজিসহ ২৫ মামলার পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও অভিযোগ। জেলা পুলিশের শীর্ষ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত। আইনের তোয়াক্কা না করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছেন বহাল তবিয়তে। গড়ে তোলেন ২০-২৫ সদস্যের সন্ত্রাসী বাহিনী। সর্বশেষ রূপসার আলোচিত সারজিল ইসলাম সংগ্রাম হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) ভোরে বাগেরহাট জেলার রামপাল কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশের ভেকুটিমারি স্থানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তিনি। এর মধ্যদিয়ে রূপসায় ‘মিনা কামাল’ সম্রাজ্যের পতন ঘটলো।
র্যাব-৬’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রওশনুল ফিরোজ জানান, মাদক ব্যবসায়ীদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে রামপালের ভেকুটিমারি এলাকায় ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় মিনা কামালের লোকজন র্যাবকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়লে আত্মরক্ষায় র্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে মিনা কামাল গুলিবিদ্ধ হন এবং তার সঙ্গীরা পালিয়ে যান। এ ঘটনায় র্যাবের দুই সদস্যও আহত হন। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মিনা কামালকে উদ্ধার করে রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিরি আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, ম্যাগজিন, গুলি, চাকু, ৬৬ হাজার টাকা ও ৫০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। সন্ত্রাসী মোস্তফা কামাল ওরফে মিনা কামালের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ২৫টি মামলা রয়েছে বলেও জানান এ র্যাব কর্মকর্তা।
রামপাল থানার ডিউটি অফিসার আসছার উদ্দীন খান জানান, র্যাব সদস্যরা সকাল ৬টার দিকে গুলিবিদ্ধ মিনা কামালকে রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসে। পরে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মিনা কামালের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে রূপসার সাধারণ মানুষ জানান, নিজ বাড়িতে এবং বীর শ্রেষ্ঠ রূহুল আমিন সড়কের একটি বরফকলে বিচারালয়ের নামে টর্চার সেল বসাতো মিনা কামাল। সেখানে বিচার-সালিেশর নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য চালানো হত অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। বিচারের নামে হাতুড়িপেটা করে হাত-পা ও পাঁজরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয় অনেকেরই। থ্যাঁতলে দেওয়া হয় শরীরের স্পর্শকাতর স্থান। এসব অপকর্মে লিপ্ত ছিল তার সহযোগী ২০ জনের সশস্ত্র বাহিনী। মিনা কামাল ও তার বাহিনীর হাতে গত ১০ বছরে অসংখ্য মানুষ নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। খুন হয়েছেন ৯ জন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ১০ জন। ভয়ে-আতঙ্কে সহায়-সম্বল রেখে পরিবার নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে অনেক নিরীহ পরিবার। মিনা কামালের সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল রূপসার কয়েক হাজার মানুষ।
বিশেষ করে রূপসার হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিক ও চিংড়ি ব্যবসায়ীরা। তাকে চাঁদা না দিয়ে রূপসায় ব্যবসা করা এবং টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা ছিল অসম্ভব। এছাড়া চুক্তিতে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্য করে গড়ে তোলেন ইট ভাটাসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ। আবার দলীয় পদ-পদবি না থাকলেও নিজেকে যুবলীগ নেতা দাবি করতেন মিনা কামাল। তার অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে স্থানীয়রা তাকে ‘ফাটা কেস্ট’ নামেও ডাকতেন।
এদিকে, মিনা কামাল অধ্যায়ের পতনের খবরে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তবে, তার বাহিনীর ভয়ে এখনও প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/৩০জুলাই, ২০২০)