রেজাউর রহমানের তিনটি কবিতা
তিমির প্রাচীর
আজ রাতটা মোজার্টের সুরে বাঁধা নয়।
আজ জোছনার জমিনটা ঢোল কলমির মত বেগুনি নয়।
আজ জোনাক আর্চি সোডিয়াম বাতির মত নয়।
আজ হিমুর পাঞ্জাবিটা হলুদ নয়।
লুদ্ধক উচ্ছলিত নয়।
নিশিকণ্যার বদনখানি গোলাপি নয়।
লক্ষ্মী প্যাঁচার নেত্র আজ বিষাদময়।
আজ যুগল অনুজীব সঙ্গমহীনতায়।
মধ্যরাতের ট্রেন শূণ্যপ্রায়।
আজ কবিতাঠাসা বই গুলো বর্ণহীনতায়।
ফুটন্ত শাবক স্তনাগ্রহীনতায়।
আন্তঃ লিঙ্গ আজ মানসিক আর্তিহীনতায়।
মেদিনী আজ দিগম্বরহীনতায়।
সব , সবকিছু আজ অন্তঃশূণ্য সারহীনতায়।
তবে, তবে কি প্রাচীন এক তিমির প্রাচীর এ অবনী?
আমিত্ব
আমি একজন আমি হতে চেয়েছিলাম।
আমি সত্যিই, একজন আমি হতে চেয়েছিলাম।
আমি একটি ডিঙ্গি নৌকা হতে চেয়েছিলাম।
প্রবহমান ঢেউয়ের সাথে নিজেকে ভাসিয়ে,
মেলে ধরতে চেয়েছিলাম।
কোন এক পানকৌড়ির সাথে,স্নিগ্ধ সকাল,তপ্তদুপুর,
বিকেলের কমলা রোদের আভা গায়ে মেখে ভাসতে চেয়েছিলাম।
প্রভাতী রবি রশ্মির উষ্ণতা , ছলাৎ ছলাৎ তরঙ্গের মূর্ছনা
সাথে নিয়ে প্রমত্ত ঝঞ্ঝার দিকে ধাবমান হতে চেয়েছিলাম।
প্রকাণ্ড নই, ছোট ডিঙ্গা হতে চেয়েছিলাম।
কুয়াশা ভাঙা ভোরের আলোয় দুটি কাছিম ছানা-
আমার গর্ভে আশ্রয়, প্রশ্রয় নিত,
ওদের ত্রাতা হতে চেয়েছিলাম।
পদ্মবিলে চৈত্রের দুপুরে এক শুনসান স্তব্ধতায় নিমগ্ন হতে চেয়েছিলাম।
গাত্রে জমে থাকা শেওলায়, খলিশাদের ঠোকা ঠুকির স্বচ্ছ
চিত্রকর্ম দেখতে চেয়েছিলাম।
গোটা বর্ষাস্নাত দিনের জলরাশিতে নিজের দীর্ঘ প্রতিচ্ছায়া
অবলোকন করতে চেয়েছিলাম।
পূর্ণ চন্দ্রতপ্ত নীলাভ অগ্নিতে পুড়াতে চেয়েছিলাম নিজেকে।
গলুইয়ের উপর বসে থাকা ঝি্ঁ ঝিঁ পোকার রঙে
নিজেকে দ্যুতিময় করতে চেয়েছিলাম।
সাঝবেলায় দিগম্বর মোহনা দেখতে চেয়েছিলাম আমি।
শূন্যতায় মিলিত হতে চেয়েছিলাম।
মস্ত নই তবুও উত্তাল জলরাশির নৃত্য-
দৃষ্টি গোচরে আনতে চেয়েছিলাম।
আমি, আমিই হতে চেয়েছিলাম।
আত্নার খোঁজ
দীর্ঘ দিন নিজেকে দেখতে পাইনি।
দীর্ঘ দিন নিজ আত্নার কুশল জানতে পারিনি।
দীর্ঘ দিন নিজের, অর্থাৎ নিজের চারপাশটা দেখা হয়ে উঠেনি।
নিজের সময়গুলোর সাথে কথোপকথন হয়না দীর্ঘদিন।
ভোরের আলোয় শরীর ছুয়ে ঘরের কোনে আহ্লাদীপনা টা দেখা হয় না দীর্ঘকাল।
ঘরের কোনের ছোট্ট মানিপ্লান্ট টা নিয়মের মত নিজেকে স্বাবলম্বী করে
তুলছে, দেখা হয় না দীর্ঘদিন।
হৃদপিন্ডের মত টিক টিক করে চলেছে হাত ঘড়িটাও,
ফিরে দেখা হয় নি দীর্ঘ দিন
নিত্যসঙ্গী মানিব্যাগটার শরীরের দীনতার খোঁজ নেওয়া হয়নি দীর্ঘদিন।
মাস পঞ্জিকার পাতা উল্টে দেখা হয়নি দীর্ঘদিন।
ঘরের কোনে টিকটিকি জুগলের সংসার হয়েছে,
বুঝতেও পারিনি দীর্ঘ দিন।
স্বরলিপি ঠাসা গানের খাতাটা,
অভিমানে ঘাপটি মেরেছে দীর্ঘদিন।
কবিতার খেরো খাতাটা মুখ লুকিয়েছে, দীর্ঘদিন।
সমরেশ,জীবনানন্দ, নবারুন,মানিকবাবু এলোমেলো
হয়ে আনাচে কানাচে দীর্ঘদিন।
শতরঞ্জিটা নিয়ত ধূলী ঝড়ে মলিনরূপে
চেয়ে আছে,দেখা হয়নি দীর্ঘদিন।
নিজের দীর্ঘছায়াটা দেখা হয়নি দীর্ঘদিন।
হেমন্ত, সলিল,মান্নাদে আজ কফিহাউজ-এর আড্ডার মতন
হারিয়ে গিয়েছে, মনে করতে পারিনি.....দীর্ঘদিন।
কখন যে দেয়ালের বর্ণটা, বিবর্ণে পরিণত হইছে
বুঝতেও পারিনি দীর্ঘদিন।
নিজের গন্ধ, বর্ণের রূপ হয়েছে ভিন্ন তাও
বুঝতে পারিনী দীর্ঘদিন।
বেগুনী আভা নিয়ে জোছনা এসে হাজির
ঘরের কোনে, দীর্ঘদিন দেখা হয়নি।
কার্ণিশে ঠাই নেওয়া শালিক যুগলের মধ্যরাতের
অভিমানী ডাকও শোনা হয়নি দীর্ঘদিন।
নিজের শ্বাসটাও দীর্ঘ হয়েছে বুঝতেও পারিনি দীর্ঘদিন।
নিজেকে ফিনিক্স পাখিতে পরিণত করেছি,
বুঝতে পারিনি দীর্ঘদিন।
পারিনি বুঝতে নিজ আত্মাকে,
নিতে পারিনি খোঁজ দীর্ঘদিন।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ আগস্ট ০৮,২০২০)