চাকরি জীবনে ওসি প্রদীপ ৩ থানা থেকে বরখাস্ত, বিভাগীয় শাস্তির মুখে ৫ বার
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। টেকনাফ থানার সাবেক ওসি। খুনের মামলায় রিমান্ডে থাকা এই আলোচিত ওসি’র বাড়ি চট্টগ্রামে। চাকরি জীবনও শুরু করেছিলেন চট্টগ্রাম থেকেই।
চাকরি জীবনের শুরু থেকে বার বার অপরাধে জড়িয়ে চট্টগ্রাম নগরীর তিন থানা থেকে প্রত্যাহার এবং সাময়িক বরখাস্তসহ পাঁচ বারের বেশি বিভাগীয় শাস্তি পেলেও প্রতিবারেই তিনি রক্ষা পেয়েছেন অজ্ঞাত খুঁটির জোরে। বার বারই তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে লোভনীয় সব থানার পোস্টিং বাগিয়ে নিয়েছেন। আর ওসি পদে থেকে নানাভাবে অনৈতিক পথে অর্থ উপার্জন করে চট্টগ্রামে রীতিমতো সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দি থাকা ওসি প্রদীপের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রদীপ দাশের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার সরোয়াতলী ইউনিয়নে। ১৯৯৬ সালে এস আই পদে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন প্রদীপ দাশ। বিএনপি সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া এস আই প্রদীপ মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ওসি পদটি বাগিয়ে নিতে ওসি প্রদীপের খুব বেশিদিন সময় লাগেনি। ঘুরে ফিরে চট্টগ্রামের সব থানাতেই ওসি পদে চাকরি করেছেন তিনি। সব থানা থেকে সাসপেন্ডও হয়েছেন।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের পতেঙ্গা থানা, ২০১৩ সালে পাঁচলাইশ থানা এবং ২০১৫ সালে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসির দায়িত্ব পালন করেন প্রদীপ কুমার দাশ। তবে একটি থানাতেও তিনি স্বস্তিতে বিদায় নিতে পারেননি। প্রতিবারই হয় সাসপেন্ড অথবা প্রত্যাহার হয়েছে নানা অপরাধে জড়িয়ে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এবং অনুসন্ধান করে জানা যায়, ২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পতেঙ্গা থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা দেওয়া, বার্জ আটক এবং বার্জ মালিকসহ ১২ ব্যক্তিকে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে।
এই ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি প্রদীপকে অভিযুক্ত করলে তাকে পতেঙ্গা থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন প্রত্যাহার অবস্থায় থাকতে হয়নি তাকে। ২০১৩ সালেই নতুন পোস্টিং পেয়ে যান নগরীর লোভনীয় থানা পাঁচলাইশে। এই থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আবারও অপরাধে জড়ান ওসি প্রদীপ।
২০১৩ সালে একটি মামলার বিরোধিতা করায় এক আইনজীবীকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় প্রদীপসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন ওই আইনজীবী।
একই বছরের ২৪ মে পাঁচলাইশ থানার পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ জন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীকে আটক এবং পৃথক একটি ঘটনায় বাদুড়তলায় বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থাকা থেকে আবারও প্রত্যাহার হন ওসি প্রদীপ।
এবারও বেশিদিন প্রত্যাহারের শাস্তি মাথায় নিয়ে থাকতে হয়নি। ২০১৪ সালে আবার পোস্টিং বাগিয়ে নেন চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানায়। এই থানাতেও ওসি প্রদীপের ফিরিস্থি প্রায় একই রকম।
২০১৫ সালে চট্টগ্রামের এক শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিকে মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। ওই শিল্পপতি তৎকালীন সময়ের পুলিশ প্রধানের ঘনিষ্ট হওয়ায় ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্তে ওসি প্রদীপের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু অল্প দিনেই ওসি প্রদীপ আবার স্বপদে ফেরেন রহস্যময় খুঁটির জোরে।
এরপর চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে কক্সবাজার। প্রথমে মহেশখালী থানা হয়ে টেকনাফ। তবে এবার বরখাস্ত বা প্রত্যাহার ছাড়িয়ে প্রদীপের ঠিকানা হয়েছে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় কারাগার।
সম্পদের পাহাড়
চাকরি হওয়ার মাত্র আট বছরের মধ্যেই চট্টগ্রাম মহানগরীর পাথরঘাটা এলাকায় জায়গা কিনে বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেছেন প্রদীপ।
পাথরঘাটা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা অরবিন্দ চৌধুরী জানান, পাথরঘাটায় ওসি প্রদীপের নির্মিত বাড়িটির নাম ‘লক্ষীকুঞ্জ’। ২০০৪ সালে স্ত্রী চুমকি দাশের নামে ছয় তলার বিলাসবহুল এই বাড়িটি নির্মাণ করেন ওসি প্রদীপ।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা মুরাদপুরে রয়েছে ওসি প্রদীপ দাসের প্রায় একশ’ কোটি টাকা মূল্যের জমি ও অট্টালিকা। এই জায়গা বোনের সাথে প্রতারণা করে লিখে নিয়েছেন বলে প্রদীপের পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
এছাড়া কক্সবাজারে একাধিক বিলাসবহুল হোটেলের মালিকানা, বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ এবং ভারতের গৌহাটিতেও তার বাড়ি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ওসি পদে থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। প্রায় ছয় মাস আগে ওসি প্রদীপকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য দুদকের পক্ষ থেকে সম্পদের হিসাব দাখিলের জন্য নোটিশ প্রদান করা হয়।
দুদক চট্টগ্রাম-০২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুর রহমান জানান, ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক কাজ করছে। এ ব্যাপারে ইতোপূর্বে তাকে নোটিশও দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে পরবর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে শিগগিরই জানানো সম্ভব হবে বলে জানান দুদকের উপ-পরিচালক।
এদিকে ওসি প্রদীপের অপর এক ভাই সদীপ কুমার দাশ দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে। ওসি প্রদীপের ব্যাপারে জানতে ওসি সদীপ কুমার দাশকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যা মামলায় কারাগারে যাওয়া এবং পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুন্ন করে নানা অপরাধে জড়ানোর বিষয়ে ছোট ভাই ওসি সদীপসহ তার পরিবারের সদস্যরা রীতিমতো বিব্রত। তারা প্রদীপের ব্যাপারে কারও সাথে কথা বলছেন না।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ওসি প্রদীপের বাড়ি লক্ষীকুঞ্জে গিয়ে স্ত্রী চুমকি দাশের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তবে তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০৭আগস্ট, ২০২০)