দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) বিরুদ্ধে চলমান আত্মসাতের মামলার পলাতক আট আসামির মধ্যে চারজন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। এই চারজন হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক এবং টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা।

মঙ্গলবার তারা ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক শেখ নাজমুল আলম তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।

একই বিচারক গত ১৩ অগাস্ট এ মামলার ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। সে অনুযায়ী, মঙ্গলবার এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

আসামিদের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী কারাগারে আছেন। আর ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম এবং সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন আগে থেকেই জামিনে আছেন।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ছাড়াও ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় এখনও পলাতক।

জামিন শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ঢাকা বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মামুন বলেন, এ মামলার মূল আসামিদের একজন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীম জামিনে রয়েছেন, যিনি ঋণটি অনুমোদন করেছিলেন সে কারণে বাকি আসামিরাও জামিন পাওয়ার ‘হকদার’।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের অন্যতম আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, “ওই আসামিদের বিষয় আর এই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এক নয়। ওই আসামিদের জামিন দিয়েছিলেন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েশ। তিনি কেন জামিন দিয়েছেন সেটা তিনিই জানেন। তবে এরা দায়ী । মামলার বিচারের এ পর্যায়ে এদের জামিন দেয়া যৌক্তিক হবে না।”

শুনানির সময় বিচারক আসামি নিরঞ্জন ও শাহজাহানকে কাছে ডেকে তাদের পরিচয় এবং অপরাধ সম্পর্কে জানতে চান। নিরঞ্জন বলেন, “আমি রনজিতের আত্মীয়। আমি কৃষক, ওর কথায় সরল বিশ্বাসে কাগজে স্বাক্ষর করেছি।

আর শাহজাহান বলেন, “আমি রনজিতের সহপাঠী ছিলাম, আমি স্কুল শিক্ষক। আমি তার কথায় একটা কাগজে সই দিই। যদি জানতাম যে এ রকম বিষয়, তাহলে তার অনুরোধ এড়িয়ে যেতাম।”

শুনানি শেষে বিচারক আত্মসমর্পণ করা চার আসামিকেই জামিন মঞ্জুর করেন। সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথম দিন মামলায় বাদী দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর সাক্ষী হিসাবে আদালতে জবানবন্দি দেন। তিনি বলেন, আসামিদের মধ্যে কেউ কেউ ‘সরল বিশ্বাসে’ কাজ করেছে। আর আসামি এ কে এম শামীম ও গাজী সালাহউদ্দিনের পক্ষে তাদের আইনজীবী শাহীনুল ইসলাম অনি বাদীকে জেরা করেন। পরে বিচারক ২৫ অগাস্ট পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করে দেন।

দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ২০১৯ সালের ১০ জুলাই এসকে সিনহাসহ ১১ জনকে আসামি করে এ মামলা দায়ের করেন।সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুইটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন।

তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।

দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর 'অস্বাভাবিক দ্রুততার' সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস কে সিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়।

পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর।

এজাহারে বলা হয়, “আসামি রনজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। রনজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জন এবং অপর ঋণ গ্রহীতা শাহজাহান ও রনজিৎ ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দুজনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি।”

তদন্ত শেষে গতবছর ৯ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ। এরপর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে এস কে সিনহাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন বিচারক। ১৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/১৮আগস্ট, ২০২০)