শেখ হাসিনা : একজন মানবিক প্রধানমন্ত্রী
শাবান মাহমুদ
করোনা দুর্যোগে বদলে গেছে বিশ্ব পরিস্থিতি। উন্নত বিশ্বেও রাষ্ট্রনায়করা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন পরিস্থিতি মোকাবিলায়। গত এক শতকে বিশ্ববাসী এমন দুর্যোগ আর দেখেনি। করোনায় আক্রান্ত কয়েক লাখ মানুষ জীবন হারিয়েছে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে। স্বজন হারানোর বেদনায় শোকার্ত সারা পৃথিবী। বিশ্বব্যাপী থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। জীবনের আনন্দ প্রায় নির্বাসিত। এক অজানা আতঙ্ক গ্রাস করছে মানব জীবনকে। চারদিকে অস্থিরতা। জীবনের কোলাহল প্রায় থেমে গেছে।
স্বাভাবিক কর্মজীবনে চরম স্থবিরতা। বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কও রীতিমতো ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ সামলাবেন কীভাবে? বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে করোনা থেকে নিরাপদে রাখার পাশাপাশি এ দুর্যোগ মোকাবিলায় তিনি কতটুকু সফল হবেন? অসহায় ও অসচ্ছল মানুষদের কতটুকু খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারবেন তিনি? বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়করাই যেখানে প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করছেন তখন শেখ হাসিনা কতটুকু সাহস জোগাবেন দেশবাসীকে। এমন অসংখ্য প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর অসীম সাহসিকতা আর মানবিকতা দিয়েই জয় করছেন সবকিছু। করোনাযুদ্ধে একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়কই নন, ইতিহাসে নাম লেখাচ্ছেন যুদ্ধজয়ের বীরত্বগাথা গৌরবে।
চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের কী হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়বে কিনা? আমাদের গণমাধ্যম শিল্পের কী হবে? দীর্ঘ সময় কাজের বিরতিতে কর্মহীন চলচ্চিত্রশিল্পীদের কী হবে? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস বন্ধ থাকলে শিক্ষকরা চলবেন কীভাবে? বেসরকারি খাতে করোনার ধাক্কায় কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়লে বেকারত্ব স্থায়ী হবে না তো? করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিবহন খাতের শ্রমিকরাই বা বাঁচবেন কী খেয়ে? এ যাত্রায় পরিবহন মালিকদের সংকট কাটবে তো? গার্মেন্টশিল্পে অচলাবস্থা হলে কর্মজীবী নারীরা কোথায় দাঁড়াবেন? খেটে খাওয়া শ্রমিকরা বাড়ি ভাড়া দেবেন কীভাবে? বিশ্বময় পরিস্থিতি যখন চরম সংকটে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক মহাপরিকল্পনায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশে দাঁড়ালেন নির্ভরতার অভিভাবক হিসেবে। দেশের ১৭ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ করল একজন সাহসী রাষ্ট্রনায়ককে। সময়ের দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রী গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা ভেবে পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের বেতন বাবদ প্রথম পর্যায়ে ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ প্রণোদনা ঘোষণা করলেন। শ্রমিকরা তাদের অসহায় চোখে দেখতে পেলেন বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন। পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দুশ্চিন্তা দূর করতে প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো চমকে দিলেন সবাইকে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জীবনের এক চরম সন্ধিক্ষণে আশার আলো পেল প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বাঁচাতে আর্থিক সহায়তা আর প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েই বসে থাকেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ৫০ লাখ পরিবারকে করোনা সংকটে খাদ্যসহায়তা দিয়ে রীতিমতো ইতিহাস গড়লেন। বিশ্ব দেখল শেখ হাসিনার অসীম সাহসিকতা আর একজন পরম মানবতাবাদী নেত্রীকে। জাতিসংঘ মহাসচিবও অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন উন্নয়নশীল দেশের একজন জনদরদি নেত্রীকে। বিশ্বনেতাদের প্রশংসায় ভাসলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণমাধ্যমকর্মীরাও দেখলেন জাতির চরম সংকটে একজন সরকারপ্রধানের সম্মোহনী নেতৃত্ব।
একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমি শেখ হাসিনার কথাই বলছি। করোনাযুদ্ধে যিনি পরম মমতা, স্নেহ আর গভীর ভালোবাসায় অসহায় মানুষকে ছায়া দিয়েছেন, বেঁচে থাকার সংগ্রামে সহায়তা করেছেন। অন্যান্য পেশাজীবীর কথা যতটা না জানি কাছ থেকে দেখা সাংবাদিকসমাজের সীমাহীন দুর্দশার চিত্র দেখেছি করোনা সংকটে। আমি দেশের সবচেয়ে বড় সাংবাদিক সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত মহাসচিব। করোনা আতঙ্কে দেশব্যাপী গণমাধ্যমে যখন অস্থিরতা তখন অনেক প্রতিষ্ঠানেই গণমাধ্যমকর্মীরা চাকরি হারাতে থাকেন। মূলধারার হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধে আগ্রহ হারান মালিক কর্তৃপক্ষ। করোনা দুর্যোগে তার যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে দাবি গণমাধ্যম মালিকদের। সাংবাদিক সংগঠনের নেতা হিসেবে আমরা কোনোভাবেই এ সংকটে নিশ্চুপ থাকতে পারি না। ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে গণমাধ্যমকর্মীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন। প্রায় প্রতিদিন সাংবাদিকদের বেকারত্ব, অনিয়মিত বেতনসহ নানাবিধ সমস্যায় সাংবাদিকদের জীবনযাত্রার অপ্রত্যাশিত ছন্দপতনে আমরা প্রচন্ড ভাবে আহত হই। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন শিল্পকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্যাকেজ প্রণোদনার দাবি জানান। প্যাকেজ প্রণোদনা পেলেই কি গণমাধ্যমকর্মীদের ভাগ্য বদলে যাবে? এমন বিশ্লেষণও উঠে আসে অনেকের আলোচনায়।
বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, আমি এবং ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান যৌথভাবে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করি। তথ্যমন্ত্রী আমাদের পক্ষ হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান সাংবাদিকসমাজের দুঃখ-দুর্দশার কথা। ইতিবাচক আশ্বাস পাই। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমও এ সময় আমাদের সহায়তা করেন। দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকা গণমাধ্যমকর্মীরাও নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পান।
ঈদের কয়েকদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তার অনুদানের চেক বিতরণ শুরু করে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। ঈদের আগে হাতে গোনা দু-একটি ইউনিয়নসহ ঈদ-পরবর্তী সময়ে শুরু হয় ঢাকার বাইরে দেশব্যাপী জেলায় জেলায় সাংবাদিকদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ। পিআইবি মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ সার্বিক সহযোগিতা করেন। বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল এবং আমি যশোর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেখেছি সাংবাদিকদের প্রাপ্তির আনন্দ। সত্যি কথা বলতে কি, আমি দেখেছি এমন অনেক সাংবাদিক আছেন যাদের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক ১০ হাজার টাকার অনুদান লাখো টাকার মূল্যমান। সন্তানের সামান্য আবদার পূরণ, সন্তানের স্কুলের বকেয়া বেতন পরিশোধ, কমপক্ষে এক মাসের খাবার মজুদ করার অর্থ পেয়ে মফস্বলের অনেক সাংবাদিক চোখের পানি ফেলেছেন। শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দুই হাত তুলে প্রার্থনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক অনুদান প্রথম পর্যায়ে আমরা ভেবেছিলাম দেশব্যাপী ইউনিয়নের সদস্যসহ বিভাগীয় পর্যায়ে মূলধারার সাংবাদিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে। প্রধানমন্ত্রী দয়ার সাগর, মানবিকতায় অতুলনীয়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সারা দেশে সাংবাদিকদের মাঝে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তার অনুদানের চেক নিয়ে বিএফইউজের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় ছুটছেন বিএফইউজের শীর্ষ নেতারা। সাংবাদিক সংগঠনগুলো উৎসব আয়োজনে গ্রহণ করছেন প্রধানমন্ত্রীর অনুদান।
সম্প্রতি ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলাসহ করোনায় বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকদের মাঝে আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে। প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে যখন ত্রাণ তহবিলের একটি কার্ড তিনি এক বৃদ্ধা মহিলার হাতে তুলে দেন তখন আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় মুহূর্তেই। কার্ডগ্রহীতা মহিলার সাফ কথা- এ কার্ড তিনি পরম যতেœ সংগ্রহে রাখবেন, তাঁর ত্রাণের দরকার নেই কারণ এটি তাঁর ভাষায়- শেখের বেটির স্মৃতি। তাঁর মানে শেখ হাসিনা কেবল একজন রাষ্ট্রনায়ক কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী নন, তিনি বাংলার মানুষের কাছে একটি অনুভূতির নাম।
ময়মনসিংহ থেকে ফিরে আমরা ছুটে যাই যশোরে যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ অনুষ্ঠানে এক চেকগ্রহীতা আমার শৈশবের বন্ধু। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বন্ধু! আজ বুক ফুলিয়ে বাসায় ফিরব। কারণ জানতে চাইলে হাসিমুখে তার জবাব- বাড়ির মালিককে বলব আপনার বাড়ির ভাড়াটা পরশু নিয়ে যাবেন। তার আবেগমাখা কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার উচ্চারণ- শেখ হাসিনা আমার কাছে সব সময় যেন আঁধারের আলো। প্রিয় প্রধানমন্ত্রী! এখানেই আপনার সার্থকতা, নেতৃত্বের সফলতা।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী! আমরা আপনার মানবিকতায় অভিভূত হই যখন দেখি শত সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে মিয়ানমার থেকে জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেন। যখন দেখি পুরান ঢাকায় অগ্নিদগ্ধে হারানো মা-বাবার এতিম সন্তানদের পরম মমতায় আপনি বুকে টেনে নেন। মায়ের দায়িত্ব নিয়ে তাদের বিয়ে দিয়ে সংসার জীবনের ব্যবস্থা করেন মহা আয়োজনে। তখন আপনার সমালোচকরাও নিশ্চয়ই আপনার মানবিকতায় মুগ্ধ হয়। যখন দেখি একটি শিশু একটি সাঁকোর অভাবে স্কুলে যেতে না পারার আক্ষেপের কথা বলে, তখন আপনি সেই খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। আপনার এসব মহানুভবতার কথা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ শুধু নয়, বিশ্ববাসীও মনে রাখবে অনন্তকাল। মহান সৃষ্টিকর্তা রব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের প্রার্থনা- বাংলাদেশের প্রয়োজনে, মানুষের নিরাপদে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শেখ হাসিনার মতো মানবিক, সাহসী ও দক্ষ নেতৃত্বই প্রয়োজন বারবার।
লেখক : মহাসচিব, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।