যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: প্রাত্যহিক জীবনে প্রত্যেক মুসলমান কিছু না কিছু আল্লাহ তায়ালার কাছে চেয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে কারও দোয়া কবুল হয়, কারো বা হয় না। আরে এই দোয়া কবুল না হওয়ার পিছনে অবশ্যই কোন না কোন কারণ রয়েছে।
অনেক মুসলমান আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করার পরও প্রত্যাশিত বিষয় না পেলে দোয়া করা ছেড়ে দেন। হতাশ হয়ে যান। অধৈর্য হয়ে পড়েন। তাদের জানা থাকা দরকার যে, দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে তিনটি বিষয়ের কোনো একটি দিয়ে থাকেন।
এক. হয়তো প্রত্যাশিত বিষয়টি দিয়ে দেন।
দুই. দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর থেকে সমপর্যায়ের বিপদ দূর করেন।
তিন. দোয়ার সওয়াব আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে তাকে দান করবেন। তাই দোয়ার পর প্রত্যাশার বিপরীত কোনো কিছু ঘটলেও ধৈর্য ধরা। অধৈর্য না হওয়া।
বিভিন্ন কারণে আমাদের দোয়া কবুল হয় না।
আসুন, জেনে নেই সেসব কারণ। পাশাপাশি দোয়া কবুলের আবশ্যকীয় শর্তগুলো সম্পর্কেও জেনে রাখা দরকার।
যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না:
খাবার, পানীয় ও পোশাক হালাল না হওয়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ পবিত্র; তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন।… তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন—দীর্ঘ সফরের ফলে যার চুল উসকোখুসকো, চেহারা ধুলোবালিমাখা। সে হাত দুটো আকাশের দিকে উঠিয়ে বলছে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’, কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম আর তার পরিপুষ্টি হয়েছে হারাম দিয়ে; (এমতাবস্থায়) কীভাবে তার দোয়ায় সাড়া দেওয়া হবে?’ [সহিহ মুসলিম: ১০১৫]
সফরে দোয়া কবুল হয়, হাত উঠিয়ে দোয়া করলে কবুল হয় এবং নিজেকে হীনজ্ঞান করে আল্লাহকে কায়মনো বাক্যে ডাকলেও দোয়া কবুল হয়। এতগুলো শর্ত লোকটি পূরণ করার পরও তার দোয়া কবুল হচ্ছে না, কেবল হারাম খাবার, পানীয় ও পোশাকের জন্য। [ইবনু রজব হাম্বলী, জামি‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম]
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা বন্ধ করে দেওয়া।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘শপথ সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই ভালো কাজের আদেশ দিবে ও অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করবে। নতুবা, অচিরেই এর ফলে আল্লাহ্ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। এরপর তোমরা তার কাছে দোয়া করবে, কিন্তু তোমাদের দোয়া সাড়া দেওয়া হবে না।’ [তিরমিযি: ২১৬৯, হাদিসটি হাসান]
দ্রুত ফল না পাওয়ায় দোয়া বন্ধ করে দেওয়া
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ আল্লাহকে ডাকলে, তার ডাকে সাড়া দেওয়া হবে, যতক্ষণ না সে অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে—‘আল্লাহকে তো ডাকলাম, কিন্তু কোনো সাড়া তো পাওয়া গেলো না।’ [সহিহ বুখারি: ৬৩৪০]
হারাম থেকে বেঁচে থাকা
দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে হারাম খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় ইত্যাদি পরিহার করা। হারাম উপার্জনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে যতই দোয়া করা হোক, তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না। রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধুলামলিন। সে আসমানের দিকে হাত প্রশস্ত করে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস : ৮৯৬৯)
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা একটি বড় ধরনের পাপ (অপরাধ)। এই পাপের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুসলিম দোয়া করার সময় কোনো গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের দোয়া না করলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে এ তিনটির কোনো একটি দান করেন।
(১) হয়তো তাকে তার কাঙ্ক্ষিত সুপারিশ দুনিয়ায় দান করেন।
(২) অথবা তা তার পরকালের জন্য জমা রাখেন।
(৩) অথবা তার কোনো অকল্যাণ বা বিপদাপদ তার থেকে দূরে করে দেন।
সহাবিরা বলেন, তাহলে তো আমরা অনেক বেশি লাভ করব। তিনি বলেন, আল্লাহ এর চেয়েও বেশি দেন। (আত-তারগীব, হাদিস : ১৬৩৩)
মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা: তিনি দোয়া সাথে সাথে কবুল না করে প্রার্থিত বস্তুর চেয়েও অধিক দেওয়ার জন্য রেখে দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখনই কোনো মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা সম্পর্ক নষ্ট করা ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখনই আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন: হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে দিয়ে দেন অথবা তার দোয়াকে তার আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন কিংবা দোয়ার পরিমাণ অনুসারে তার অন্য কোনো (অনাগত) বিপদ তিনি দূর করে দেন।’ [তিরমিযি: ৫/৫৬৬, আহমাদ: ৩/১৮, সহিহ সনদ]
দোয়া কবুলের আবশ্যকীয় শর্তগুলো:
শিরকমুক্ত দোয়া
শর্তহীনভাবে শুধু আল্লাহর কাছেই বলা, মানুষকে দেখানো বা শোনানোর উদ্দেশ্য না থাকা।
আল্লাহ্ বলেন, ‘দ্বীনকে (ইসলামকে) আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করে শুধু আল্লাহকেই ডাকো।’ [সূরা গাফির, আয়াত: ১৪]
দোয়া কবুলের পূর্ণ বিশ্বাস রেখে দোয়া করা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা দু’আ কবুলের দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো।’ [সহিহ আল জামে’: ২৪৫, হাদিসটি হাসান]
অন্তরকে সজাগ রাখা ও উদাসীনতা পরিহার করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘…কোনো বান্দা অমনোযোগী অন্তরে দোয়া করলে, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন না।’ [সহিহ আত তারগিব: ২/১৩৩, হাদিসটি হাসান]
আল্লাহ্ যেকোনো দোয়া কবুল করতে পারেন, (বৈধ) যেকোনো কিছু দিতে পারেন, এই বিশ্বাস রাখা।
এভাবে দোয়া করতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে যে, ‘হে আল্লাহ! তোমার ইচ্ছা হলে আমাকে দাও।’ [সহিহ বুখারি: ৬৩৩৮] সুতরাং, এভাবে দোয়া করা যাবে না।
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর জন্য কোনো কিছুই এত বড় নয় যে, তিনি তা দিতে পারবেন না।’ [সহিহ মুসলিম: ২৬৭৯]
আল্লাহর গুণবাচক নাম
দোয়ার শুরুতে এবং দোয়ার শেষে আল্লাহ তায়ালার সুন্দর সুন্দর নাম এবং তার মহিমান্বিত গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহকে ডাকার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চাওয়া।
সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতিতে দোয়া করা
দোয়া করার ক্ষেত্রে স্পষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত অথচ দ্যোতক অর্থবহ শব্দ নির্বাচন করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দোয়া হল সর্বোত্তম দোয়া। তবে একজন ব্যক্তি তার চাহিদা অনুযায়ী তার নিজস্ব ভঙ্গিতে দোয়া করতে পারবে।
সুতরাং দোয়া করতে হবে দৃঢ়তার সাথে। যে সকল কাজগুলো আল্লাহকে অখুশি করে সেগুলো থেকে বিরত থাকুন । আল্লাহ তায়ালা আপনার উপর খুশি থাকলে আপনার দোয়া এমনি কবুল হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দোয়ার ফলাফল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন: যে ব্যক্তি দোয়া করবেন হয়তো আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন, অথবা তিনি দোয়ার উছিলায় তার উপর থেকে অমঙ্গলজনক কিছু দূর করবেন। সর্বোপরি আমাদের এ বিশ্বাস রাখতে হবে আল্লাহ যা করেন তার সবই আমাদের মঙ্গলের জন্য।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/৩১আগস্ট, ২০২০)