কোভিড-১৯ মহামারীতে পুষ্টি বিবেচনা
ড. শাহজাদা সেলিম: ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা কোভিড-১৯ রোগটিকে বৈশ্বিক মহামারী বলে ঘোষণা করে। সারা পৃথিবী কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্তান্ত যা সার্স কোভ২ ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত মারাত্নক ছোঁয়াচে রোগ। গতকাল বিকালে জেনেভায় সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিশ্বের সবক’টি দেশ বা অঞ্চলে মোট ২৫১ লাখ ৭০ হাজার ২৭৪ জন মানুষ এ ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মোট মৃত মানুষের সংখ্যা ৮৪৬,৭৯২। বাংলাদেশে গত কাল পর্যন্ত মোট ৩০৮, ৯২৫ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত এবং ৪,২০৬ মারা গিয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
এটি মোটামুটি অনুধাবিত হয়েছে ইতোমধ্যে যে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়া বা না হওয়া এবং আক্রান্ত হলে মারাত্মক অবস্থায় উপনীত হবার সাথে মানুষের শারীরিক অবস্থার, প্রধানত পুষ্টির একটি নিবিড় সংযোগ রয়েছে। এ সংযোগের মুল ভিত্তিটা হয়েছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি’র কারণে। শরীরের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একজন মানুষকে কোভিড-১৯-এর সংক্রমনের হাত থেকে বা এতে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। তাই তাই এ মহামারীতে খাদ্য গ্রহণে সুষম খাদ্য এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা এমন খাদ্য উপাদানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যারা নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারি; সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হবার কম ঝুঁকিতে থাকেন।
এ সব বিবেচনা করে, শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, খাদ্য আঁশ, আমিষ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পেতে তাজা-অপ্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাওয়া দরকার। প্রচুর জলপান করতে হবে বা যে সব খাবারে বেশী জলীয় অংশ আছে, সেগুলো গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভীতামিন ডি’র ভুমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, জিঙ্ক ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ।
কোভিড-১৯ মহামারীর সঠিক খাদ্য গ্রহণের সহায়ক কিছু পন্থা এখানে আলচিত হলো।
প্রতিদিন তাজা অপ্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ করবেন
রঙিন ফল, শাক-সব্জি, ডাল- বীচি জাতীয় খাদ্য (শিম, মসুর, মাষ, ছোলা ইত্যাদি), বাদাম, আস্ত শস্যদানা-- ভুট্টা, জোয়ার, গম, লাল চাল; কান্ড বা মুল জাতীয়
শ্বেতসারযুক্ত শাক-সব্জি—কচু, মিষ্টি আলু; প্রানিজ খাদ্য—মাছ, মাংশ, দুধ, ডিম খান।
প্রতিদিন ২ কাপ ফল (৪ পরিবেশনা, সপ্তাহের অধিকাংশ দিন), আড়াই কাপ শাক- সব্জি (৫ পরিবেশনা), ১৮০ গ্রাম শস্য, ১৬০ গ্রাম মাছ, মাংশ ও ডাল জাতীয় খাদ্য খাবেন। লাল মাংশ (গরু, ভেড়া, ছাগল) সপ্তাহে ২-৩ বার, মুরগীর মাংশ সপ্তাহে ৩-৪ বার এবং ডিম প্রতিদিন খাওয়া যেতে পারে (সিদ্ধ ডিম হলে ভালো)।
হাল্কা খাবার/ স্ন্যাক্স হিসেবে চিনি-লবন-চর্বিযুক্ত খাদ্য না খেয়ে কাচা/তাজা ফল-মুল বেছে নিন।
শাক-সব্জি বা ফল অতিরিক্ত সিদ্ধ/ রান্না করবেন না।
প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, টিনজাত বা শুকনো খাদ্য বর্জনীয়।
প্রত্যেহ ৩-৩.৫ (১০ গ্লাসের মত) লিটার জলপান করবেন। কম মিষ্টি বা টক স্বাদের ফলের রস পান করা যেতে পারে।
কম চর্বি যুক্ত বা ননীমুক্ত এমন দুধ বা দুগ্ধজাত পন্য বেছে নিতে পারেন পানীয় হিসেবে।
বাইরে খেতে থেকে বিরত থাকুন। কোমল পানীয়, যাতে উচ্চ মাত্রায় চিনি আছে (ঘনীভুত ফলের রস, মিষ্টি ফলের রস, ঠাণ্ডা পানীয়, সোডা ইত্যাদি) পরিহার করতে হবে। ডায়াবেটেসের সকল রোগীর জন্য প্রায় সকল সময়ই ফলের রস খাওয়া অনুচিত হবে [হায়পোগ্লাইসেমিয়া হলে ফলের রস পান করলে রক্তের গ্লুকোজ দ্রুত বাড়াতে তা সহয়াতা করবে]।
চা- কফি (চিনিমুক্ত) পান করতে পারেন। অনেকের জন্যেই কফি পান বিশেষ উপকারি হতে পারে। ডায়াবেটিসের রোগীদের সময়মত খাদ্য গ্রহণ (৩টি বড় ও ৩টি ছোট; প্রায় ৩ ঘন্টা পর পর) খাদ্য গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। অতিরিক্ত চিনি/মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ থেকে তাদেরকে বিরত থাকতে হবে।
দৈহিক স্থুলতা হতে নিজেকে রক্ষা করুন। তবে, তার জন্যে চটকদার বিভিন্নরকম জীবন- যাপন প্রণালী বা খাদ্য প্রণালীর দিকে ঝুঁকে যাবেন না। সুষম খাদ্যই আপনাকে রক্ষা করবে; কিটো ডায়েট বা এরূপ আরও কিছু বিজ্ঞাপিত খাদ্য ব্যবস্থাপনা ডায়াবেটিসের রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি যেমন বৃদ্ধি করছে, তেমনই অন্যদের (নন-ডায়াবেটিস) জন্যে
মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
যাদের শারীরিক সক্ষমতা আছে, তাদেরকে অবশ্যয়ই নিয়মিত ব্যায়াম/ শারীরিক শ্রম সম্পাদন করতে হবে। এ মহামারীতে বাসাবাড়ির ভিতরেই/ সম্ভব হলে ছাদে/ গ্যারেজে হাঁটা বা খালি হাতের ব্যায়াম করা যেতে পারে। যাদের পক্ষে সম্ভব, ট্রেডমিল বা ব্যায়ামের সাইকেল চালাতে পারেন। ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সুষম খাদ্য কাঠামোর মধ্যেই ক্যালরি কমিয়ে নিতে হবে আর শারীরিক শ্রমের মাত্রা বাড়িয়ে ক্যালরি গ্রহণ ও ক্যালরি খরচের মধ্যে একটি ঋণাত্মক
সমন্বয় দাঁড় করাতে পারেন।
চমকপ্রদ- আশাব্যঞ্জক তথ্য হলোঃ কোভিড-১৯ মহামারীতে নিজেকে রক্ষা করতে সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত- পরিমিত শারীরিক শ্রম অভাবনীয় ভুমিকা রাখতে পারে।
[তথ্যসুত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে প্রাপ্ত বয়স্কদের পুষ্টি ভাবনা]
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/৩১আগস্ট, ২০২০)