দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কালজয়ী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। মাত্র ২০ বছর বেঁচে ছিলেন পৃথিবীর বুকে। এইটুকু বয়সে অন্যসব তরুণ যখন কলেজ-ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বই-খাতা কাঁধে নিয়ে দোড়ায়, তখন সুকান্ত সৃষ্টি করলেন অবিস্মরণীয় সব কবিতা। যেগুলো জায়গা করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও একজন কবি এসেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা তার সঙ্গেও খেলেছেন এক ব্যতিক্রম খেলা। অন্যসব অভিনেতার মতো তিনি বছরের পর বছর কিংবা দশকের পর দশক ধরে কাজ করতে পারলেন না। দেখাতে পারলেন না তার ভেতরের জ্বলন্ত প্রতিভার আগুন। কেবল তিনটি বছর দিয়েছেন সিনেমার পর্দায়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই তিন বছরেই তিনি চিরকালের অমরত্ব অর্জন করে নিয়েছেন। সুকান্তের মতো তিনিও জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। তারুণ্যের প্রিয় তারকা হিসেবে।

তিনি সালমান শাহ। আমাদের চলচ্চিত্রের সুকান্ত। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন অমর নায়ক সালমান শাহ।

দেশজুড়ে যখন যুদ্ধ চলছে, স্বাধীনতার জন্য যখন বাঙালি লড়ছে প্রাণপণে; সে সময় জন্ম নিলেন সালমান শাহ। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। স্বাধীন দেশে নতুন সুর্য এলো তার জন্মের কয়েক মাস পরই। সেই নতুন সুর্যের মতো সালমান শাহও দেশের চলচ্চিত্রে নিয়ে এলেন নতুন কিছু। যা তার মৃত্যুর দুই যুগ পরেও এখনো নতুন!

সিলেটের দড়িয়া পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সালমান শাহ। তার আসল নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তিনি পড়াশোনা করেছেন খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুলে। উল্লেখ্য, এই স্কুলে কালজয়ী চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার সহপাঠী ছিলেন। ঢাকার ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন সালমান শাহ। এরপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ধানমন্ডির মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম. পাশ করেন।

অভিনয় জগতে সালমান শাহর আগমন ঘটে ১৯৮৫ সালে। বিটিভির ‘আকাশ ছোঁয়া’ ছিল তার অভিনীত প্রথম নাটক। এরপর তিনি ‘দেয়াল’, ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’, ‘সৈকতে সারস’, ‘নয়ন’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেছেন। সাবলীল অভিনয়ের সুবাদে তখন সালমান শাহ দর্শকদের কাছে মোটামুটি পরিচিতি পেয়েছিলেন। এছাড়া ‘নয়ন’ নাটকের জন্য তিনি বাচসাস পুরস্কারও পেয়েছিলেন।

যেই সালমান শাহ এখনো অমর, যাকে এখনো সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, সেই সালমান শাহর জন্ম হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহানের পরিচালনায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় অভিনয় করেই দেশজুড়ে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সালমান শাহ। রাতারাতি বনে যান সিনে দুনিয়ার তারকা। এই সিনেমাতে তার সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন তার স্কুল জীবনের সহপাঠী মৌসুমী। বলে রাখা প্রয়োজন- ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মধ্য দিয়ে সালমান শাহ, মৌসুমী এবং কণ্ঠশিল্পী আগুন চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এবং তারা তিনজনই পেয়েছিলেন তারকাখ্যাতি।

প্রথম সিনেমা দিয়ে সালমান শাহ এতোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, নির্মাতা-প্রযোজকরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তাকে ঘিরে। একের পর এক সিনেমায় তাকে যুক্ত করলেন, আর সালমানও অভিনয় করে গেলেন। যার ফলে ১৯৯৪ সালেই সালমান শাহ অভিনীত ছয়টি সিনেমা মুক্তি পায়। ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখি’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’ ও ‘প্রেমযুদ্ধ’ নামের সিনেমাগুলোতে তখন পুরো দেশে উৎসব চলছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে যেন সাফল্যের জোয়ার এসেছিল সালমানের হাত ধরে। সাধারণত বছরে এক নায়কের একটি বা দুটি সিনেমা সাফল্যের মুখ দেখে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সালমান শাহ অভিনীত প্রায় সব সিনেমাই পেয়েছিল সাফল্য।

১৯৯৫ সালে আরও ছয়টি সিনেমা মুক্তি পায় সালমান শাহর। এগুলো হচ্ছে ‘দেনমোহর’, ‘কন্যাদান’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘মহামিলন’ ও ‘আশা ভালোবাসা’। এর মধ্যে ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ তো রীতিমতো দর্শকপ্রিয়তার আকাশ ছুঁয়ে ফেললো। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সফল সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটাকে। এছাড়া ‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমাটিও পেয়েছিল অসামান্য জনপ্রিয়তা।

এরপরের বছর তথা ১৯৯৬ সাল। সালমান শাহর মৃত্যুর বছর। কিন্তু সেই আকস্মিক মৃত্যুর কথা কে-ই বা জানতো! সে বছর সালমান শাহ অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা ৯! এর মধ্যে তার মৃত্যুর আগে মুক্তি পেয়েছিল ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’ ও ‘স্বপ্নের পৃথিবী’। চলে যাওয়ার বছরে সালমান শাহ যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিলেন সিনে পর্দায়। যার ফলে এ বছরে তার সাফল্যের পরিধিও চড়া।

একই বছর সালমান শাহর মৃত্যুর পর মুক্তি পেয়েছিল ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’ ও ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’। সবক’টি সিনেমা হয়েছিল দর্শকপ্রিয় এবং ব্যবসাসফল। প্রিয় নায়ককে হারানোর শোকে তার প্রতি ভালোবাসা থেকে দর্শকরা ছুটে গিয়েছিল সিনেমা হলে।

১৯৯৭ সালে সালমান শাহর আরও পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে- ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’ এবং ‘বুকের ভেতর আগুন’। সাফল্যের ধারা অব্যাহত ছিল এই সিনেমাগুলোতেও। কিন্তু ততদিনে তো নিভে গেছে ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপ শিখাটি!

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢালিউডের সেই কালো দিন। এই দিনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান সালমান শাহ। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি চলে যান। ইস্কাটনে তার নিজ বাসাতেই ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল সালমানের। প্রাথমিকভাবে তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে নানাবিধ রহস্য আসে সামনে। যার ফলে সালমান শাহর মৃত্যুর তদন্ত শুরু হয়। যদিও সেই তদন্তের কাজ এখনো চলমান! মৃত্যুর পর দুই যুগ চলে গেলেও সম্পূর্ণভাবে সেই রহস্যের কিনারা হয়নি এখনো।

সালমান শাহ চলে গেছেন, আত্মহত্যা নাকি খুন; সেই প্রশ্নের উত্তর হয়ত কখনো জানা যাবে, হয়ত যাবে না। তবে এতটুকু সবারই জানা, তিনি অমর। বাংলা সিনেমার সেই লালচে পর্দায় তিনি যেই নতুনত্ব দেখিয়েছেন, যতটা আধুনিক ফ্যাশন তিনি তৈরি করেছেন, সেগুলো আজও অম্লান। এখনো তাকে দেশের সিনেমায় ফ্যাশন আইকন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাণিজ্যিক সিনেমায় গল্প ও অভিনয়ের প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়গুলো তার সিনেমা থেকেই এসেছে। যার ফলে আধুনিক বাণিজ্যিক সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ সালমান শাহ।

আবারও ফিরে আসেই সুকান্তে। হৃদয় উজাড় করে সুকান্ত লিখে গেছেন, আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার লেখা পড়ছে, পড়ে যাচ্ছে। তেমনি সালমান শাহ-ও অভিনয় করে গেছেন, আর যুগের পর যুগ সেটা দেশের সিনেমায় আদর্শ হিসেবে নতুনদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/১৯সেপ্টেম্বর, ২০২০)