নটর ডেমে পড়ায় ‘খ্রিস্টান’ অপবাদে সমাজচ্যুত তরুণ
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করায় জুয়েল খান (২৫) নামে এক তরুণকে ‘খ্রিস্টান’ অপবাদ দিয়ে গ্রাম্য মাতব্বররা তার পরিবারকে সমাজচ্যুত করে রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমানা বিরোধের জের ধরে সালিশ বসিয়ে গত চার মাস তাদের সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে সমাজের সবাইকে নিষেধও করেছে সালিশকারীরা। গত ১ মে অনুষ্ঠিত ওই সালিশে জুয়েলকে উদ্দেশ করে বলা হয়, ‘তুই খ্রিস্টান কলেজে পড়েছিস, তুই খ্রিস্টান। তোর জন্য তোর পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হলো।’ এ ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে আদালতে একটি মামলা করে জুয়েলের পরিবার। জুয়েল উপজেলার তরফপুর পাথালিয়াপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে। তিনি ২০১৩ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ৪০তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি।
গত শনিবার জুয়েলের স্বজনরা দেশ রূপান্তরকে জানান, তাদের কেউ সমাজের কোনো লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার চেষ্টা করলে বাড়িঘর ভেঙে এলাকা ছাড়া করার হুমকিও দেয় সালিশকারীরা। এ ছাড়া গত ঈদুল আজহায় তাদের সামাজিকভাবে পশু কোরবানিতেও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় টাঙ্গাইল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, প্রতিবেশী শরিফুল ইসলামের (৩৫) সঙ্গে বাড়ির সীমানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলে আসছিল জুয়েলের পরিবারের। এর জেরে গত ১ মে জুয়েলদের বাড়ি প্রবেশ করে লাঠি ও লোহার রড দিয়ে তাদের সবাইকে মারধর করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সময় স্থানীয় মসজিদের খন্ডকালীন মুয়াজ্জিন একই গ্রামের মাসুদ মিয়া (২৫) জুয়েলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুই (জুয়েল) খ্রিষ্টান কলেজে (নটর ডেম কলেজে) এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় লেখাপড়া করেছিস। তুই নাস্তিক। নাস্তিকের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তোর জন্য আজ থেকে তোর পরিবার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন (একঘরে) থাকবে।’ তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ওই মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলামও। এ সময় জুয়েল ও তার ভাই মারুফ খান এর প্রতিবাদ করায় হত্যার চেষ্টায় আবারও মারধর করে অভিযুক্তরা। এতে জুয়েলের বাবা মফিজুল ইসলাম (৬৫), মা আমেনা বেগম (৫৫), নানী ইয়ারন বেগম (৮০), ভাই মারুফ খান (৩০) ও দেড় বছরের ভাতিজা মাহির আহত হন। এরপর চিৎকারে শুনে এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় জামুর্কী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে আশপাশের লোকজন। এ ঘটনায় উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে বলে জুয়েলের মা আমেনা বেগম জানান।
শনিবার দুপুরে জুয়েলের বাবা মফিজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেকদের। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘গত চার মাস ধরে আমরা বাড়ির বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। নিজেদের জরুরি দরকারেও বাইরে যেতে ভয় করে।’
তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত শরিফুল ইসলাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। জুয়েলের পরিবার সমাজের কারও সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারে না।’ আরেক অভিযুক্ত মাসুদ মিয়ার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
স্থানীয় তরফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আব্দুল বাছেদ মিয়া বলেন, ‘জুয়েলদের পারিবারিক বিরোধের সালিশ করতে গিয়ে আমরা মামলার আসামি হয়েছি।’
মির্জাপুর থানার ওসি মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘জুয়েল খান নটর ডেম কলেজে পড়ার কারণে স্থানীয় কতিপয় মাতব্বর বিচারের নামে তাকে খ্রিষ্টান উপাধি দিয়ে তার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়। বিষয়টি খুবই অমানবিক। একাধিকবার তদন্ত করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আদালতে মামলা করে ভুক্তভোগীরা।’
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২১সেপ্টেম্বর, ২০২০)