সত্যের কলম যেন থেমে না থাকে
ড. মুহাম্মদ ওমর ফয়সল
কলম হচ্ছে আল্লাহ্ রাব্বুল আ'লামিন প্রদত্ত একটি বড় নিয়ামত। যাঁরা কলমকে সত্য ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা দুনিয়াতে হাজার বছর বেঁচে থাকেন। কলম না থাকলে পৃথিবীতে কোন কিছুই প্রতিষ্ঠিত হতো না। দুনিয়ার কায়-কারবারও সঠিকভাবে পরিচালিত হতো না। দয়াময় প্রভু মানবজাতিকে অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় করে সৃষ্টি করে তাদের হাতে কলম উঠিয়ে দিয়েছেন। আর এ কলমের সাহায্যেই তারা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি, বিজ্ঞান, শিল্প-কলা, তথ্য-প্রযুক্তি লিখে দিন দিন আধুনিকতার চরম উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। কলমকে বলা হয় হৃদয়ের জিহবা, জড় জগতের সবচেয়ে সম্মানী বস্তু। মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে ইহা অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। এর শক্তি অপরিসীম। ইহা এক প্রচন্ড দ্রোহ, শাণিত কৃপাণ, অসত্যের বিরুদ্ধে এক বজ্রকঠিন হাতিয়ার। টেইলর বলেছেন, ‘কলম হলো যন্ত্রপাতির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক। ইহা তরবারীর চেয়েও ধারালো, চাবুক বা লোহার ডান্ডার চেয়েও ভয়াবহ'। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘Pen is mighter than the sword'.
হযরত কাতাদাহ বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম তাকদীরের কলম সৃষ্টি করেছেন। এ কলমই সৃষ্টি জগৎ ও সৃষ্টির ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেছে। এরপর দ্বিতীয় কলম সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয় প্রকার কলম দ্বারাই পৃথিবীর অধিবাসীরা লিখে থাকে। রাসূল সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ তা'য়ালা সর্বপ্রথম কলম ও নূন তথা দোয়াত সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কলমকে বললেন - লিখ। কলম জিজ্ঞাসা করল, কী লিখব? আল্লাহ বললেন কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে সবই লেখ। যথাযথ লেখার পর কলমের মুখে মোহর করে কথা বলার শক্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত কলম আর কথা বলতে পারবে না। অতঃপর আল্লাহ পাক বিবেক সৃষ্টি করে বলেন, আমি আমার ইজ্জতের শপথ করে বলছি যে, আমার প্রিয় লোকদের মধ্যে আমি তোমাকে পরিপূর্ণতা দান করব আর অপ্রিয় লোকদের মধ্যে তোমাকে অসম্পূর্ণ রাখব'। এটা আল্লাহ তায়ালার বড় কৃপা যে, তিনি তাঁর বান্দাদেরকে অজ্ঞাত বিষয়সমূহের জ্ঞানদান করে ধন্য করেছেন এবং তাদেরকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে টেনে নিয়ে এসেছেন। তিনি মানুষকে লিখন বিদ্যার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কেননা, যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ইতিহাস, জীবনালেখ্য ও উক্তি, আল্লাহ তায়া'লার অবতীর্ণ কিতাবসমূহ যাবতীয় বিষয়াদিই কলমের সাহায্যে লিখিত হয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে। কলম সৃজিত না হলে ইহকাল ও পরকালের সবকাজ কর্মেই বিঘ্নিত হতো।
কলমের একটি মাত্রই কাজ; আর তা হলো লেখা। চার্লস গ্রভিল বলেছেন, ‘একটি কলমের সাহায্যে যেভাবে হৃদয়ের কথা উৎসারিত হয়, তেমনি আর কিছুতেই হয় না'। যিনি কলমের সাহায্যে সমাজের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, জুলুম-অনাচার ও নির্যাতন-নিপীড়ন দূর করতে চান তাকে হতে হয় সত্যের পক্ষে অকুতোভয় সৈনিক। তাকে মোকাবিলা করতে হয় নিদারুণ দুঃখ-মুসিবত, চলতে হয় নিঃসীম অন্ধকার পথে-ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের উপর দিয়ে, পার হতে হয় কাঁটাবনের ঠিক মাঝখান দিয়ে, বন্ধু করে নিতে হয় ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর অভাব-অনটনকে। পৃথিবীর বড় কলম সৈনিকদের জীবনেতিহাস পাঠ করলে আমাদের সামনে উপরোক্ত চিত্রগুলোই ফুটে উঠে। আল্লামা ইকবাল, জর্জ বানার্ড 'শ, কাজী নজরুল ইসলাম, ইমাম গাযালি, ইবনে তাইমিয়া, আল ফারাবি, শেখ সা'দী প্রমুখের সংগ্রামী জীবন এবং তাদের ক্ষুরধার লেখনীই বিশ্ব সভ্যতাকে অজ্ঞতার তিমির থেকে টেনে তুলে আলোর সোনালি দিগন্তে নিয়ে আসে। যে কলম দেশাত্মবোধ, মানবতা, উদারতা, মহানুভবতা প্রতিভার বিকাশ সাধন করে মানুষের সঠিক পরিচয় তুলে ধরে প্রভুর সাথে যথাযথ সম্পর্ক তৈরি করে দিতে পারে না, সে কলম ধারালো কলম নয়; সে কলম ভোঁতা কলম, অকেজো কলম। আর সম্ভবত এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় কলম সম্পর্কেই ছড়াকার লিখেছেন-
দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে,
উহ্ বড্ড লেগেছে!
যে কলম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করে তামাম দুনিয়ার মানুষকে শান্তির সামিয়ানায় এনে দাঁড় করায়। যে কলম নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সর্বহারা, দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্তদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠভূমিকা রাখে; সে কলমই নৈতিক কলম, কল্যাণকামী কলম, সংগ্রামী কলম। আর এ কলমই সমাজের বিনির্মাণের শাণিত হাতিয়ার, এমন এক সম্মোহনী শক্তি যার শক্তি হাজারো তরবারী থেকেও ধারালো। কলমকে যদি প্রকৃতির ভাষা হিসেবে নিরূপণ করা যায় তাহলে এর সাহায্যে প্রকৃত শৈল্পিকসৌন্দর্য ফুটে উঠবে। রুশো বলেন, Everything is good as it leaves the hands of the author of nature; everythings denigrates in the hand of man. (প্রকৃতির পত্র-পল্লবের সংস্পর্শে সবকিছুই সুন্দর, মনোহর; কিন্তু মানুষের দ্বারা এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে)।
জ্ঞানী সম্প্রদায় বলেন, ‘জগতে তিনটি কলম আছে। ১) আল্লাহ তায়ালার কুদরতী হস্তে সৃজিত কলম, একে তিনি তাকদীর লেখার কাজে আদেশ করেছিলেন। ২) ফেরেশতাদের কলম, যা দ্বারা তারা ভবিতব্য ঘটনা, তার পরিণাম এবং মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন। ৩) সাধারণ মানুষের কলম : যা দিয়ে তারা নিজেদের কথা-বার্তা, অর্জিত জ্ঞান, ভাবাবেগ, চিত্ত চেতনার কথা লেখে এবং নিজেদের অভিষ্ট কাজে ব্যবহার করে'। লিখন প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার বর্ণনা এবং বর্ণনা মানুষের এক বিশেষ গুণ যা আল্লাহ্পাক প্রদত্ত। প্রখ্যাত তাফসীরবিদ মোজাহিদ আবু আমের বলেন, ‘মহান আল্লাহ্পাক চারটি বস্তু স্বীয় কুদরতী হস্তে সৃষ্টি করেছেন। এ চারবস্তু ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টিজগৎ ও বস্তুসমূহ ‘কুন' -তথা হয়ে যাও আদেশের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্র স্বহস্তে সৃজিত চারটি বস্তু হলো-কলম, আরশ, জান্নাতুল আদন ও হযরত আদম (আঃ)।
মনীষীরা বলেছেন, ‘বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র'। তাই কলমকে বানাতে হবে সত্যের প্রতিষ্ঠা আর মিথ্যা বিতাড়নের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটা হবে ধারালো অস্ত্র। নীতির প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতি নির্মূল করণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এ কলমই পারে মননশীল সাহিত্য রচনার মাধ্যমে জাতিকে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে, দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে।
আল্লাহপাক বলেন, ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না'। (সূরা আলাক ৪-৫) রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তায়ালা যখন আদিকালে সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তার কাছে রক্ষিত কিতাবে একথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে'। ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, ‘সত্যিকার জ্ঞানী হতে হলে সর্বদা নিজকে জ্ঞান অন্বেষণে মগ্ন রাখতে হবে। আর যে নিজকে জ্ঞানী ভেবে নেয় সে প্রকৃত জ্ঞানী নয়, সে মূর্খ'। হযরত ঈসা (আ.) বলেন, ‘অসৎ জ্ঞানীর উপমা সেই পাথরের ন্যায় যেটি ঝর্ণার মুখে পড়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়; সে নিজেও পানি পান করে না এবং শস্য ক্ষেতেও পানি যেতে দেয় না'। হযরত সুফিয়ান সওরী (রহঃ) বলেন, ‘এলেম চিৎকার করে আমলের আহবান জানায়, তার দাবি এ আহবানে সাড়া দিলে এলেম থাকে, অন্যথায় বিদায় নিয়ে চলে যায়'। আর কলমই হলো জ্ঞান লিখার একমাত্র মাধ্যম।
বর্তমান পৃথিবীতে যাদের কলমের জোর বেশি তারাই শক্তিশালী। বিশ্ব চলে তাদের দাপটে, পৃথিবীকে মেনে নিতে হয় তাদের কর্তৃত্ব। একসময় মুসলমানদের কলমের শক্তি ছিল প্রবল। তারা তাদের কলমের আঁচড়ে সারা পৃথিবীকে আলোয় আলোকিত করে তুলেছিল। তাদের দোয়াতের কালিতে লেখা হয়েছে জ্ঞান- বিজ্ঞানের সবগুলো অধ্যায়। অধুনা পৃথিবী আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের গৌরব-গাথা, কৃতিত্বের কথা,তাদের ক্ষুরধার লিখনীর কথা। কেননা তাদের কলমের ধারালো লিখনীই পৃথিবীকে করে তুলেছে উদ্ভাসিত ও দীপ্তিময়। এভাবে যতদিন মুসলমানদের হাতে কলম ছিল ততদিন পৃথিবীবাসী তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। আর এখন তারা কলম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েশের জিন্দেগী শুরু করার মাধ্যমে নিজেদের ললাটে অপমান আর জিল্লতির কলঙ্কটীকা নিজেরাই লিখে দিয়েছে।
আজ তাই পৃথিবীর সর্বত্রই শোনা যায় তাদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার, তাদের রাঙ্গা খুনে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজ-শ্যামল পৃথিবী। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো আবার কলম হাতে নেয়া। হারানো গৌরবগুলো পুনরুদ্ধার করা। জাতির এ ক্রান্তিকালে জ্ঞানীর গবেষণা যেন থেমে না যায়, কলমের কালি যেন শুকিয়ে না যায়, জবান যেন স্তব্ধ হয়ে না যায়। সত্যের কলম যেন থেমে না থাকে।
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, চিন্তক ও ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ