প্রসূতি মায়ের খাদ্যভ্যাস
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: আমাদের দেশে শিশু ও মায়ের পুষ্টির বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত থেকে যায়। আমরা জন্মের পর থেকে শিশুকে ফর্মুলা দুধ বা বাহ্যিক খাবার খাওয়াতে বেশি গুরুত্ব দিই, যেটি মোটেই উচিত নয়। সম্পূর্ণ অপরাধ! আজকে আপনাদের কাছে আলোকপাত করলাম মা ও শিশুর পুষ্টি নিয়ে।
গর্ভবতী মায়ের গর্ভের শিশুর উপযুক্ত বৃদ্ধি ও মায়ের সুস্থতার জন্য অতিরিক্ত সুষম খাবার না খেলে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না বরং মা ও শিশু দুজনেই নানা রকম পুষ্টিহীনতায় ভোগে। স্তন্যদাত্রী মায়ের শিশুকে পর্যাপ্ত দুধ সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত খাবার না দিলে শিশু পর্যাপ্ত দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। ঠিক তেমনি বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও সুষম খাবারের অভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি হয়।
মাতৃগর্ভ থেকেই শিশুর পুষ্টি শুরু হয়। কাজেই গর্ভে থাকা শিশুর পুষ্টি ও মায়ের সুস্থতার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ‘পুষ্টি চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়, যেমন- গর্ভকালীন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মায়ের জরায়ু, স্তন্য, নাভী রজ্জু ইত্যাদি অঙ্গের বৃদ্ধি ও বিপাক ক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। তাই এসব কার্যকলাপের জন্য ক্যালরির চাহিদা বেশি থাকে। এছাড়া গর্ভস্থ সন্তানের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, গ্রন্থি, কলা ও কোষের গঠন ও বৃদ্ধির জন্য এবং মায়ের শিশুর পর্যাপ্ত রক্ত গঠনের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিনের প্রয়োজন হয়।
এজন্য উচ্চ জৈব মূল্যের প্রোটিন যেমন মাছ, মাংস, ডিম, লৌহ ও ফলিক এসিডের জন্য কলিজা, ভিটামিন ‘সি’ এর জন্য লেবু, আমলকী, পেয়ারা, কাচামরিচ ইতাাদি খাওয়া যায়। বাচ্চার হার, হাড্ডি, দাঁত, নখ, চুল যাতে ঠিকমতো গঠন হয় এবং মায়ের হার ক্ষয় বা পাতলা না হয় তার জন্য ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ‘ডি’ এর প্রয়োজন হয়।
আর যদি এসবের অভাব হয় তাহলে মায়ের হার থেকে ভ্রণের দেহে এসব ব্যবহৃত হয়। ফলে মা ও শিশু দুইজনেরই হার দুর্বল হয়। অনেক বাচ্চাকে দেখা যায় একটু দৌঁড়ালেই তাদের পা ব্যাথা হয়। এ জন্য গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত দুধ, ছোটমাছ, ‘ডি’ এর জন্য কডলিভার অয়েল, সবুজ ও রঙিন শাকসবজি খেতে হয় এবং প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত অন্তত ১৫-২০ মিনিট রোদে থাকতে হয় যাতে চামড়ায় সরাসরি রোদ লাগে। এতে শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি হয়।
থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধির জন্য আয়োডিনযুক্ত খাবার খেতে হয়। গর্ভবতী অবস্থায় সব ধরনের পুষ্টি চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সেটা মেটানো কঠিন কিছু নয়। সুষম খাদ্য তালিকার মাধ্যমে এই সময়ে ক্যালরি, প্রোটিনসহ অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ ধাপে ধাপে বাড়াতে হয়। সঙ্গে মৌসুমি শাকসবজি ও ফলমূল অবশ্যই খেতে হয়।
স্তন্যদানকারী মায়ের খাবারের চাহিদা বিশেষ করে ক্যালরি, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। কারণ-
১. বুকের দুধ নিঃসৃত করার কাজটি করতে তাকে প্রচুর শক্তি ক্ষয় করতে হয়। প্রায় প্রতিদিন ৬৫০-৮৫০ মিলি লিটার দুধ উৎপাদন করতে হয় তাকে। এর জন্য অতিরিক্ত ২০০-৪০০ ক্যালরি প্রয়োজন হয়। তাই দৈনিক স্তন্যদানকারী মায়ের খাদ্য প্রায় ৭০০-১০০০ ক্যালরি সরবরাহ থাকা উচিত। অবশ্য বাচ্চার বয়স ৬ মাস পেরিয়ে গেলে যখন বুকের দুধের পরিমাণ কমে যায় তখন ক্যালরির পরিমাণও কমে যায়।
২. বুকের দুধে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে উৎকৃষ্টমানের প্রোটিন, ক্যালরি, ভিটামিন ও মিনারেল।
৩. মায়ের নিজের দেহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সব ধরনের পুষ্টি প্রয়োজন।
এই সমস্ত চাহিদা পূরণের জন্য স্তন্যদানকালে প্রসূতি মায়ের যে চাহিদা থাকে তা গর্ভাবস্থার চেয়ে অনেক বেশি।
জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত শিশুর ওজন বৃদ্ধির হার উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়। এর কারণ ৬ মাস বয়সের পর শিশুর বিশেষ পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব। মাতৃগর্ভ থেকে যেসব উপাদান নিয়ে শিশু জন্ম নেয় তা ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ শিশুকে নানা রকম অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে। তাই পরবর্তীতে বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার দেয়া হয়। এই খাবার দেয়ার উদ্দেশ্য হলো পারিবারিক খাবারে অভ্যস্ত করানো যাতে শিশুর পুষ্টি চাহিদা অনুযায়ী তার সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকে।
জন্মের পর থেকে বাচ্চাদের যে বর্ধন প্রক্রিয়া চলে তা প্রায় ১৮/১৯ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এই সময় পুষ্টির চাহিদাও বেশি থাকে। কৈশোরে যদি এই চাহিদা পূরণ না হয়, তবে দেহ গঠন ও বর্ধন যথাযথভাবে হবে না। বরং নানারকম অপুষ্টির লক্ষণ দেখা দিবে এবং দুর্বল ও অপুষ্ট হওয়ায় সংক্রামণ ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হবে। ফলে সারাজীবনই দুর্বল ও রোগা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
লেখক : বিএসসি ইন নার্সিং (চবি), এমপিএইচ ইন নিউট্রিশন (ইবি), নার্স ও পুষ্টিবিদ।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২৬ অক্টোবর, ২০২০)