দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: আরও একটি খ্রিষ্টীয় বর্ষ বা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি পুরনো হয়ে গেল। নতুন বর্ষপঞ্জির পাতা খুলল আজ। তবে এবার পুরনো বছরের বিদায় আর নতুনের আগমনের উদযাপনটা আর সব বারের মতো নয়। বিশ্বজুড়ে ভিন্ন আবহ। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কবলে পৃথিবী থমথমে। ভয়ের কালো মেঘে ঢাকা ছিল ২০২০ বছরের আকাশ। সে মেঘ এখনো কাটেনি- মানুষের প্রাণময় চলাচল সীমিত হয়ে আছে দেশে দেশে।

তবে নতুন বছরের প্রাক্কালে এই ভয়াতুর দিন কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। করোনার প্রতিষেধক তৈরি আর তা মানবদেহে প্রয়োগের সাফল্য বিশ্বে আশার দীপ্ত রেখাপাত স্পষ্ট করেছে। ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের ভয়ে তটস্থ বিশ্ব আবার জাগবে নবপ্রাণে।

কোভিড-১৯ নামের এই মহামারি গোটা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। ঠুনকো করেছে বৃহৎ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর অহমিকা। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে লাখো মানুষ। ব্যক্তিপর্যায়ে জীবনযাত্রায় এনেছে পরিবর্তন। কবি শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার পঙক্তি ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র মতো করোনায় মুখ ঢাকছে মাস্কে। মুখ ঢেকে থাকা শুধু নয়, একাকী জীবন কেমন হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতাও এনে দিয়েছে মানুষের জীবনে। কীভাবে ঘরবন্দি মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জীবন রক্ষার তাগিদে, করোনা তা দেখিয়েছে। করোনার কারণে সামাজিক ও বন্ধুত্বের অনেক সম্পর্কের মাঝে দূরত্বকে দীর্ঘ করেছে। আবার প্রকৃত বন্ধু, সহযোগী চেনার সুযোগও মিলিয়ে দিয়েছে।

২০২০ সালকে বলা যায় হারানোর বছর। হতাশার বছর। অপ্রাপ্তি আর উদ্বেগের বছর। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব সব ক্ষেত্রেই একই ছবি। বিপর্যস্ত হয়েছে অর্থনীতি। দেশে দেশে কমেছে জিডিপি, আমদানি-রপ্তানি। কোটি কোটি মানুষ হারিয়েছে চাকরি। লোকসান দিয়েছে ব্যবসায়।

বাংলাদেশেও এর অভিঘাত কম পড়েনি। তবে দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। করোনা সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার ছায়া ফেললেও বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনার আঘাতের ক্ষতি অনেকটাই সারিয়ে উঠতে পেরেছে, পারছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), বৈদেশিক মুদ্রা আয়, পুঁজিবাজারে রেকর্ড সূচক সেই কথাই বলছে।

করোনার মধ্যেও সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি পদ্মা সেতুর ধাতব অবকাঠামো তৈরির কাজ শেষ হওয়া। একে একে ৪১টি স্প্যান বসেছে ৪২টি খুঁটির ওপর। চলছে সড়ক ও রেলপথ তৈরির কাজ। করোনার মধ্যেও পদ্মা সেতুর মতো দেশের মেগা প্রকল্পের কাজ চলেছে অনেকটা স্বাভাবিক গতিতে। থেমে ছিল না উন্নয়নের যাত্রা। সরকারি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ঠিক রাখতে সচেষ্ট ছিল সরকার। এতে সরকারি কাজে নিয়োজিত নির্মাণশ্রমিকের কম সংখ্যকই কর্ম হারিয়েছেন।

বেসরকারি খাতে এই চিত্রটা একেবারেই আলাদা ছিল। কর্মসংস্থান হারিয়েছে অনেক মানুষ। বেকার হয়ে পড়েছেন মুহূর্তেই। আয়ের পথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহর ছেড়ে গ্রামেও পাড়ি দিতে হয়েছে কর্মজীবী মানুষকে। কারণ শহরে টিকে থাকতে হলে যে ধরনের অর্থযোগের প্রয়োজন তা ছিল না তাদের। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করল তখন আবার তাদের একটি অংশ রাজধানীতে ফিরে এলেন বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজে। অনেকে সন্ধান পেয়েছেন, আবার অনেকে চাকরি ছেড়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার তালিকায় না তুলেছেন।

উৎপাদনের চাকা কঠোর লকডাউনে কিছুটা বন্ধ ছিল। কিন্তু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কদিন বাদে পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলে আবারও চাকা ঘুরেছে কল-কারখানায়। রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা অবশ্য লকডাউনে ক্ষতির মুখের পড়েছে বেশি। দেশে উৎপাদান সচল থাকলেও বিদেশি ক্রেতারা স্ব স্ব দেশে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। কলকারখানার পাশাপাশি হাটবাজারেও বিকিকিনি ছিল সীমিত পর্যায়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ছাড়া লকডাউনে তালা ঝুলেছে অন্য বিপণি বিতানে।

করোনা মানুষের জীবনাচারণেও পরিবর্তন এনেছে বেশ। মাস্ক হয়েছে নিত্যসঙ্গী। পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তনের অভ্যস্ত ছিল না মানুষ। সময়ের প্রয়োজন মানিয়ে নিয়েছে ঠিক। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের দাবিদার বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। উন্নয়নশীল দেশ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। নতুন বছরের শুরুতেই কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক আসতে যাচ্ছে দেশে। সব ধরনের দূতিয়ালি চলছে। প্রতিষেধকগুলো সংরক্ষণেও প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। কীভাবে, কাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা বা প্রতিষেধক দেওয়া হবে সেই পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পুরনো বছরের মহামারির প্রকোপ থেকে নতুন বছরে মুক্তির পথ খুলছে দেশের মানুষের জন্য।

করোনার মধ্যে দেশের অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছিল তা কাটিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বিশ্বমন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন সচল ও ঊর্ধ্বমুখী ছিল এখনো সেই পথেই হাঁটছে দেশ। গত অক্টোবর পর্যন্ত জিডিপির অগ্রগতি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বছরের শেষ দিনে পুঁজিবাজারের সূচক রেকর্ডের ঘরে রয়েছে।

তবে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ধারায় হাঁটলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো খোলা হয়নি। শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ শিশুরা সব ধরনের মহামারিতে বেশি ঝুঁকি থাকে। করোনাতেও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ঠিকই চলছে ক্লাস। পরীক্ষাও নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতি অটোপাস বা মেধাবিচারে ঊচ্চমাধ্যমিক পাসের ব্যবস্থা করেছে সরকার। যাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না হয়। পিছিয়ে পড়তে না হয়। সরকারের এই উদ্যোগও প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও এনিয়ে সমালোচনাও রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে।

করোনা অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে পৃথিবীকে। চিরচেনা পৃথিবীর রূপ যেন বদলে গেছে কোনো এক দানবের আগমনে। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। যদিও করোনা এখন আর শুরুর মতো ভয়ের কারণ নয়। করোনা আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠা মানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং নিয়ম মেনে চলছে করোনা থেকে সহসা মুক্তি পাওয়া যায়। করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা। করোনা আক্রান্ত হলেও উদ্বিগ্ন না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঘরে থাকার বিকল্প নেই।

করোনাকে জয় করা এখন আর ভয়ের বিষয় নয়। কেবল নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রাখা প্রয়োজন। নতুন বছরে করোনার প্রতিষেধক নিরাপদ জীবনের পথে এগিয়ে নেবে মানুষকে। বিশ্বকে মুক্ত করবে মহামারি থেকে। বিষণ্ন সময় ভুলে আবারও সবাই নতুন পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে, নতুন বছরের নতুন সূর্যালোকে এই প্রত্যাশা।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০১ জানুয়ারি, ২০২১)