বিশ্বজুড়ে সমাদৃত মহামানব শেখ সাদি
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ‘অযোগ্য লোককে দায়িত্ব দেওয়া চরম দায়িত্ব হীনতা’, ‘অকৃতজ্ঞ মানুষের চেয়ে কৃতজ্ঞ কুকুর শ্রেয়’, ‘মিথ্যাবাদীর স্বরণশক্তি অধিক’, ‘ভদ্র লোক সেই, যে সত্যের উপাসক’, ‘বল অপেক্ষা কৌশল শ্রেষ্ঠ ও কার্যকারী’- এরকম অসংখ্য উক্তির জনক পারস্যের বিখ্যাত মহাকবি শেখ সাদি। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাভাষী পাঠকের কাছে অতি প্রিয় কবি তিনি। শুধু বাঙালিই নয়, বিশ্বজুড়ে তিনি অত্যন্ত সমাদৃত। তাকে নিয়েই আমাদের আজকের এ আয়োজন।
শেখ সাদি। জন্ম ১২১০ খ্রিস্টাব্দে; ইরানের শিরাজ-এ। আবার এটাও বলা হয়েছে জন্মসাল ১২০৮ বা তারও অল্প আগে। তিনি ইন্তেকাল করেন ১২৯১ অথবা ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে। তার পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মোশাররফ উদ্দিন বিন মোসলেহ উদ্দিন আবদুল্লাহ সাদি সিরাজি। তিনি ইরানের সুপ্রসিদ্ধ ‘সিরাজ’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে দেশের রাজদরবারে সাদির বাবা চাকরি করতেন। সাদির বাবার নাম সৈয়দ আবদুল্লাহ। মায়ের নাম মাইমুরা খাতুন। কৈশরের আগেই কবির বাবা মারা যান। এ কারণে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল অনেক কষ্টে। তার মা তাকে নিয়ে বড় কঠিন বিপদে পড়ে যান। এরপর রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পিত হয় তার নানার ওপর। কিন্তু নানার অবস্থাও সচ্ছল ছিল না। এদিকে স্বভাবকবি বলেই সাদির জ্ঞান, তৃষ্ণাও ছিল প্রবল।
অভাব, দারিদ্র আর কষ্টের মধ্যে ছেলেকে কীভাবে মানুষ করবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান সাদির মা। এতিম সাদিকে নিয়ে তার মা কতটা কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তা কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন। উঠতি যৌবনে বেপরোয়া সময়টাতে একদিন মূর্খতাবশত মায়ের সামনে চিৎকার করে উঠলে মা ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মনে হচ্ছে, তুমি তোমার শৈশব ভুলে গেছ, তাই তেজ দেখাচ্ছ।
সাদিকে নিয়ে মায়ের ভাবনার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তার অসম্ভব মেধাশক্তি। ছোট্ট শেখ সাদি আর্থিক অনটনে স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক ধনী ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ কথাটিতে ছিল তার প্রগাঢ় বিশ্বাস। বাগদাদ নগরীতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ২১ বছর বয়সে শেখ সাদি একটি কবিতা লিখে বাগদাদের প্রধান বিদ্যালয়ের নিজামিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আবুল ফাতাহ বিন জুজিকে দেন। সেই শিক্ষক তা পড়ে মুগ্ধ হয়ে শেখ সাদির মাসোয়ারার ব্যবস্থা করে দেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সঙ্গে ধর্ম, দর্শন আর নীতিশাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করে ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি মক্কায় হজ করতে যান।
তার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য— তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। সে সময়ের পারস্য ছাড়াও তুরস্ক, সিরিয়া, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আরব, মিসর, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমাংশ ভ্রমণ করেন। তার বয়স যখন আশি বছর তখন বাগদাদ নগরী হালাকু খান দ্বারা আক্রান্ত হলে হালাকু খানের নৃশংসতায় তিনি মর্মান্তিক কষ্ট পান। ভিতরে ভিতরে এতই কষ্ট পান যে তাকে পীড়িত করতে থাকে। বাগদাদের সঙ্গে ছিল তার হৃদয়ের সম্পর্ক।
ফারসি সাহিত্যে প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে। প্রবাদটি হচ্ছে- ‘সাত জন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফারসি সাহিত্য টিকে থাকবে।’ আর এই সাত জন কবি হচ্ছেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী, ফেরদৌসী, হাফেজ, নিজামী, শেখ সাদী, রুদাকি এবং জামি।
এখন পর্যন্ত শেখ সাদীর ২২টির মতো গ্রন্থের নাম জানা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গুলিস্তাঁ, বূস্তাঁ, করিমা, সাহাবিয়া, কাসায়েদে ফারসী, কাসায়েদে আরাবিয়া, গযলিয়াত, কুল্লিয়াত ইত্যাদি।
মহাকবি শেখ সাদীর এসব অনন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘গুলিস্তা’ বেশ সমাদৃত। যা লিখিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত শ’ বছর আগে। পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রণে লিখিত গ্রন্থ ‘গুলিস্তা’-এ বিধৃত সৌন্দর্যসুষমা, নৈতিকতা, অলঙ্কার উপমা আভরণ যেভাবে শৈল্পিক বিন্যাসে শোভিত ও আয়ুষ্মান, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
মহানবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের প্রতি নিবেদিত অমর উজ্জ্বল পঙ্ক্তিমালার অনুরণন, শিহরণ বিশ্বমানবের প্রিয়তা ও ভালোবাসা অর্জন করেছে। শেখ সাদী তার গুলিস্তা গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন :
বালাগাল উলা বিকামা’লিহি
কাশাফাদ দুজা বি’জামালিহি
হাসুনাত জামিয়ু খিসালি’হি
সাল্লু আলাইহে ওয়া আ’লিহি।
শাশ্বত আবেদনঋদ্ধ এসব পঙ্ক্তিমালা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম নিয়মিত পাঠ করে থাকেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।
তাঁর লেখা বুস্তান বইটি সর্বকালের সেরা ১০০ বইয়ের মাঝে স্থান পেয়েছে। তিনি মাস্টার অফ স্পিচ, দ্য মাস্টার ইত্যাদি বহু খেতাবেই পরিচিত।
তাঁকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। পারস্যের এ বিখ্যাত কবি দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে একবার গিয়েছেন অভিজাত এক ব্যক্তির বাড়ি। পরনে ছিল সাদাসিধে পোশাক। এই পোশাকের কারণে তাকে তেমন আপ্যায়ন করা হয়নি। মুড়ি-মুড়কি খেয়েই বিদায় নিতে হয় শেখ সাদীকে।
পরে কোনো এক উপলক্ষে সাদী ওই বাড়িতে আবারও যান। এবার কবির পরনে ঝকঝকে চকচকে মূল্যবান পোশাক। গৃহকর্তা নিজেই সেদিন খাবার এগিয়ে দিলেন। সাদী সব খাবার না খেয়ে আলখাল্লার জেবে ঢোকাতে লাগলেন। গৃহকর্তাসহ সবাই এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত! সাদী তখন ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘আমি তো কিছু নই। আমার সব সম্মান তো আমার পোশাকের জন্য। সেই বরং খাক এ সব খাবার!’
শেখ সাদীর এ গল্পের নাম ‘পোশাকের গুণ’। পোশাক দিয়ে ব্যক্তির পরিচয় আর সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের এই রীতি পাল্টে দিতেই তার এই নিরব প্রতিবাদ। সেই সময় শ্রেণী বৈষম্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন শেখ সাদি।
এই গল্পের মূল বাণী হচ্ছে- মানুষকে মানুষ হিসাবেই মর্যাদা দিতে হবে। তার অর্থসম্পদ বা পোশাক-আশাক দেখে নয়। মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো কোনও দৃষ্টান্ত আর কোনও লেখকের রচনায় মিলবে কিনা সন্দেহ। শেখ সাদীর অন্য গল্পগুলোও এমনই সব মহত্তর মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত।
শেখ সাদী তাঁর সাহিত্যকর্মের সর্বত্রই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর ‘গুলিস্তাঁন’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত একটি উদ্ধৃতি হচ্ছে-
‘সবল বাহু আর শক্তিশালী হাতের পাঞ্জায়
নিরীহ দুর্বলের হাত ভাঙা বড় অন্যায়।
পতিতের প্রতি যে দয়া দেখায় না, সে কি ভয় পায় না
নিজে পতিত হলে কেউ যে এগিয়ে আসবে না?
মন্দের দানা বুনে যে দিন কাটে ভালোর আশায়
ভ্রান্ত চিন্তায় ঘুরপাক খায় বেভুল বাতিল কল্পনায়।
কানের তুলা বের করো, শোধ কর মানুষের প্রাপ্য
যদি না দাও, সেদিন ফেরত দেবে অবশ্যই।
আদমসন্তান পরস্পর এক দেহের অঙ্গ
সৃষ্টির উৎসে তাদের উপাদান যে অভিন্ন
কালের দুর্বিপাকে ব্যথিত হয় যদি একটি অঙ্গ
স্বস্তিতে থাকতে পারে না বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
অন্যদের দুঃখে-কষ্টে তুমি যে নির্বিকার
তোমাকে মানুষ বলা অনুচিৎ, অবিচার।’ (গুলিস্তাঁন, প্রথম অধ্যায়, হেকায়েত-১০)
এই উদ্ধৃতিতে সাদী অধিকারবঞ্চিত, দুর্বল, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের যে গভীর আবেদন রেখেছেন তা অতুলনীয়। মানব সমাজকে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্তিময় করার আদর্শ ও শিক্ষা সাদী প্রচার করে গেছেন তাঁর অমর সাহিত্যে। মানুষের চেতনার দুয়ারে করাঘাত করে তাদের চিন্তার পরিশুদ্ধির সূত্রে সুন্দর চরিত্র ও আদর্শ সমাজ নির্মাণের উপাদান যোগান দিয়েছেন।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে রয়েছে একটি বিশাল কার্পেট। জাতিসংঘের প্রবেশপথের দেয়ালে সেঁটে থাকা সেই কার্পেটটি ইরানি জনগণের পক্ষ থেকে দেওয়া উপহার। যার মাঝখানে লেখা আছে মহাকবি শেখ সাদির একটি কবিতা।
বলা হচ্ছে- ‘সব মানুষ এক দেহের অঙ্গসম; যেহেতু সবার প্রথম উপাদান একই। যখন একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, বাকি অঙ্গও তখন স্থির থাকতে পারে না। অন্যের দুর্যোগে যদি উদ্বিগ্ন না হও, তবে তোমার নাম মানুষ হতে পারে না।’
২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মার্চ মাসে ইরানের নববর্ষ (নওরোজ) উপলক্ষে সে দেশের জনগণকে ভিডিওর বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা পাঠান। সেখানে বারাক ওবামা কোট করেন শেখ সাদির একই কাব্যাংশ। তিনি বলেন, এটি ঠিক যে, আমরা নিজেদের মধ্যে কতগুলো বিভাজনের কারণে বিভক্ত হয়ে আছি। তবে আমরা সেই শব্দগুলো মনে রাখতে পারি, যা কবি সাদি লিখে রেখেছেন বহু বছর আগে। আদম সন্তান সবাই এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো, যেহেতু সবাই একই উপাদান থেকে তৈরি।
শেখ সাদির জীবনীকারগণ তার জীবনকে চার ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন।
১. প্রথম ত্রিশ বছর তিনি শিক্ষা অর্জন করেছেন।
২. তারপর ত্রিশ বছর তিনি মানুষের বিচিত্র জীবনকে কাছ থেকে দেখতে প্রাচ্য, ভারতবর্ষ, দূর পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
৩. এরপর ত্রিশ বছর তিনি অব্যাহত লেখালেখি করেছেন। ভ্রমণের শেষ দিকেও তিনি প্রচুর লিখেছেন।
৪. আর বাকি ত্রিশ বছর, অর্থাৎ শেষ জীবন তিনি কাটিয়েছেন শিরাজে যুগ সংস্কারক বেশে এবং আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায়।
অর্থাৎ— সাদি সর্বোপির ১২০ বছর জীবিত থেকেছেন।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২১ জানুয়ারি, ২০২১)