আব্দুল্লাহ শুভ,দ্য রিপোর্ট:

যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)বলছে,জুলাই ২০২০ পর্যন্ত সংস্থাটিতে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৫৫ টি।আর পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকার বেশি এমন কোম্পানি  রয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০ টি । কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত  কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩৫৮ টি।যদিও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনে, কোন কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ৫০ কোটি টাকার বেশি হলেই  পরবর্তী এক বছরের মধ্যে  পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্তির বাধ্যবাধকতা আছে।আইন থাকার পরও এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনা যাচ্ছেনা। বাজারে নতুন কোম্পানি না আসায় পুঁজিবাজারে অর্থপ্রবাহ ঠিক থাকছে না। এর ফলে দেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের ভূমিকা জোড়ালো হচ্ছেনা।বাজারে নতুন আইপিও না আসা বা তালিকাভূক্তির প্রক্রিয়ায় জটিলতা থাকায় নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে আগ্রহ পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

 

 

 

বাজার বিশ্লেষণ রিপোর্ট অনুযায়ী,২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের জিডিপির আকার ছিল ২৭০ বিলিয়ন ডলার এবং পুঁজিবাজারের বাজার মুলধন ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপির অনুপাতে মাত্র ১৮ শতাংশ। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি বেড়ে দাড়িয়েছে ৩৭৮ বিলিয়নে। এসময়ে পুঁজিবাজারের বাজার মুলধন দাড়ায় মাত্র ৯ শতাংশে বা ৩৫ বিলিয়ন। কিন্তু জিডিপির অনুপাতে পুঁজিবাজারের মুলধন থাকা উচিত কমপক্ষে ৪০ শতাংশ। পরবর্তীতে অনুপাতের হার না বেড়ে পরের বছর আরও বরং কমেছে। কিন্তু পাশের দেশে ভারতে বাজার মূলধনের অনুপাত জিডিপির প্রায় ৬৩ শতাংশ। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশের ৭ গুণ।

বাজারে নতুন কোম্পানির আসার অনীহার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করছে বলে বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন। এর মধ্য আইপিও অনুমোদন পেতে দীর্ঘসূত্রিতা অন্যতম। তাছাড়া, বিশেষক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার মনোভাব না থাকা ,বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে না পারাও অন্যতম কারণ। তবে গত বছরের মে মাসের শেষদিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আইপিও মার্কেট চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সে বছর রবিসহ ১৯ টি কোম্পানি বাজার থেকে ১৫৮০ কোটি টাকা উত্তোলন করে যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গত ১৫ বছরের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৭ সালে ১৪ টি কোম্পানিকে আইপিও অনুমোদন দিয়েছিলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।নতুন আইপিও আসার পর তখন সূচকের বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যায়। বছরের ব্যবধানে সূচক বাড়ে ১৪৩৪ পয়েন্ট।

২০০৮ সালে অনুমোদন পায় ১২টি কোম্পানি, যারা উত্তোলন করেছিলো ৮২৭ কোটি টাকা। নতুন আইপিওর সংখ্যা তুলনামূলক কমে গেলে এর প্রভাব পড়ে বাজারে। যেখানে সূচক ৩০১৭ পয়েন্ট দিয়ে বছর শুরু হয় সেখানে বছরে শেষে সূচক কমে দাড়ায় ২৭৯৫ পয়েন্টে। অর্থ্যাৎ সূচক কমে ২২২ পয়েন্ট।

২০০৯ সালে ছিল নতুন করে ১৮ টি কোম্পানি আইপিও অনুমোদন পায় । যার প্রভাব সরাসরি বাজারে পড়ে।কোম্পানিগুলো বাজার থেকে মোট উত্তোলন করেছিলো ২৩১৪ কোটি টাকা। ২৮০৭ পয়েন্ট নিয়ে বছর শুরু হলেও বছর শেষে সূচক দাড়ায় ৪৫৩৫ পয়েন্টে।

২০১০ সালে আবারও ১৮ টি কোম্পানি অনুমোদন লাভ করে। বাজার থেকে কোম্পানিগুলো সংগ্রহ করেছিলো ২৬৫৩ কোটি টাকা । এতে শেয়ারবাজারে চাঙা ভাব দেখা যায়। বছর শুরু হয় ৪৫৩৫ পয়েন্ট নিয়ে ,বছর শেষে সূচক দাড়ায় ৮২৯০ পয়েন্টে।

২০১১ সালে ১৪ টি কোম্পানি তালিকাভূক্ত হয়। এ বছর কোম্পানিগুলো উত্তোলন করে ১৮৭৯ কোটি টাকা। সংগ্রহ বছরের শুরুতে সূচকের চাঙ্গাভাব থাকলেও বছর শেষে সেটি প্রায় অর্ধেক ৪৫৩৫ পয়েন্টে নেমে আসে।

২০১২ সালে আইপিও সংখ্যা কমে দাড়ায় ৯টিতে । তারা বাজার থেকে উত্তোলন করে ৮৭০ কোটি টাকা। বছর শেষে সূচক কমে প্রায় ৭০০ পয়েন্ট। আইপিওর সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব বাজারে দেখা যায়।

২০১৩ সালে রাজনৈতিক কারণে পুঁজিবাজার অস্থিরতা দেখা যায়। ২০১৩ সালে ১৯ টি কোম্পানি ও ২ টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ মোট ২১ টি প্রতিষ্ঠান তালিকাভূক্তির অনুমোদন পায়।

২০১৪ সালে ১২ টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন লাভ করে। সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো ৮৩০ কোটি টাকা উত্তোলন করে।

অপরদিকে ২০১৫ সালে ৩টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ মোট ১২টি সিকিউরিটিজ ৮ হাজার ৩০৭ মিলিয়ন টাকা পাবলিক অফারিং এর মাধ্যমে মূলধন উওোলন করে৷ এর মধ্যে ৭টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ বাজার থেকে মূলধন উওোলন করে ৪ হাজার ৫৬৬ মিলিয়ন টাকা৷ ২০১৫ সালের শুরুতেই প্রথম তিন মাস রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের পুঁজিবাজারকে কিছুটা সংকুচিত করে।এ বছর বাজার মুলধন কমে ১৪ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি সূচক কমে ৩৪৭ পয়েন্ট। এবছর আইপিওর শেয়ারের মুনাফা ৪০ শতাংশ কমে যায়।

২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়ে ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। বছর শেষে সূচকের উত্থান দেখা যায়। ৪৬২৯ পয়েন্ট নিয়ে শুরু হওয়া সূচক বছর শেষে দাড়ায় ৫০৩৬ পয়েন্টে। অর্থ্যাৎ বছর শেষে সূচক বাড়ে ৪০৬ পয়েন্ট।

২০১৭ সালে ৮টি কোম্পানি আইপিও অনুমোদন পায়। ৮ টি কোম্পানি মাত্র ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে। ফলে বাজার মুলধনে ঋণাত্বক প্রবণতা দেখা যায়।

২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি ৭৫ লাখে টাকা উত্তোলন করে। সূচকের পাশাপাশি লেনদেন,বিদেশি বিনিয়োগ বাজা্র মুলধনসহ সবকিছুতেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে। এর ফলে বছরব্যাপীই বাজারে অস্থিরতা দেখা যায়। আলোচ্য বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ শতাংশ শেয়ার সমন্বিতভাবে কিনে নেয় চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ।তারপরও বছর শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ৮৫৯ পয়েন্ট কমে যায়।

২০১৯ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে ৫টি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩টি কোম্পানি অর্থাৎ ৮টি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে আইপিও’র মাধ্যমে ৫৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।

২০২০ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে ৫টি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩টি কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছে। সম্মিলিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম বাবদ তিনটি কোম্পানি নিয়েছে এক হাজার ৩৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

অর্থ্যাৎ দেখা যাচ্ছে, যে বছর ভাল মানের আইপিও সংখ্যা বেড়েছে সে বছর বাজারে চাঙ্গাভাব দেখা গেছে। বাজারে মুলধনের পরিমানও বেড়েছে। বেড়েছ বিনিয়োগকারীদের আস্থাও । ফলে বাজারে আইপিওর সংখ্যা বাড়লেও সেটা বাজারের জন্যেই ভাল হবে বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমরা কমিশনের কাছে বারবার সুপারিশ করেছি এলিজেবল কোম্পানিগুলোর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু সময়ক্ষেপনের ফলে কোম্পানিগুলো খালি হাতে নিরাশ হয়ে ফিরে গেছে। বর্তমান কমিশন বেশ আন্তরিক হলেও আইপিও অনুমোদনে গতি কিন্তু তেমন একটা বাড়েনি। তাছাড়[ নতুন কমিশনের অধীনে যে কয়টি আইপিও তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলো আগের কমিশনের অধীনেই আবেদন করেছিল। আমি বলতে চাইছি – বাজারে ভাল মানের কোম্পানি আছে। এবং সেসব কোম্পানির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কমিশন আরেকটু গতি নিয়ে কাজ করতেই পারে’।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র (চলতি দায়িত্ব)মো.রেজাউল করিম দ্য রিপোর্টকে জানান, বাজারে নতুন আইপিও আসুক এটা কমিশন চায়। তবে সে আইপিও হেলদি হতে হবে। ভাল পারফরমেন্স করা কোম্পানিগুলোকে অনুমোদন দিতে কমিশন বসে আছে। কিন্তু যারা অনুমোদন লাভের জন্য আবেদন করছেন তাদের প্রোফাইল ভাল হলে কমিশন তড়িৎ গতিতে অনুমোদন দিচ্ছে। কিন্তু নন-পারফর্মিং কোম্পানিগুলো যাচাইয়ে আটকে যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদী অচিরেই নতুন ১৪ টি কোম্পানি আইপিও অনুমোদন পেতে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, কমিশন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। কোন কোম্পানিকে জোর করে বাজারে আনা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, জোর করে খারাপ মানের আইপিও বাজারে এনে বাজার অস্থিতিশীল করার কোন মানে হয়না।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মো ইউনুসুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, বাজারে নতুন আইপিও আসলে বাজারে মুলধনের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বাজার চাঙ্গা হয়। তাই, নতুন আইপিও আসুক এটা আমরা সবাই চাই। তবে, যাচ্ছেতাই মানের কোম্পানিকে আমরা আইপিও অনুমোদন প্রাপ্ত হিসেবে দেখতে চাইনা। নতুন কমিশন এ বিষয়ে খুবই সাবধানী পদক্ষেপ ফেলছে উল্লেখ করে তিরি বলেন, কমিশন যাচাই-বাছাই করে নতুন আইপিও আনছে। অনুমোদন প্রদানে কমিশন আগের চেয়ে অনেক কম সময় নিচ্ছে। বাজারের উন্নয়নে কমিশনের দিক নির্দেশনায় স্টক এক্সচেঞ্জগুলোও ভাল করছে। এখন পুঁজিবাজারে সুসময় বিরাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে এ ধারা বজায় রাখতে হলে বাজারে ভাল মানের আইপিও আনা জরুরী।

দ্য রিপোর্ট/এএস/১৮মার্চ২০২১