দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বাংলাদেশী শিল্প গ্রুপ ওয়ালটনের উৎপাদিত টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকুলার মেশিন সহ নানা ইলেকট্রনিক্স পণ্য এখন জাপানী পণ্যকে পিছনে ফেলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাজার দখল করছে। এ কারণে জাপানীদের দূশ্চি:ন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে ওয়ালটন। তারা এখন ওয়ালটনের এই অভাবিত উন্নতির পেছনে কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কথাগুলো বলছিলেন দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ ওয়ালটনের নির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিম। 

পুঁজিবাজার বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরাম (সিএমজেএফ) এর সদস্যদের গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পরিদর্শনকালে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথা বলেন তিনি।

রবিবার (২৮ মার্চ) কারখানা পরিদর্শন কালে তার এ কথার প্রমাণও পেয়েছেন সাংবাদিকরা্। এই পরিদর্শক দলের সঙ্গে দ্য রিপোর্টের এ প্রতিবেদকও চারটি কারখানা পূংখানোপুঙ্খ ভাবে ঘুরে ঘুরে দেখেন। ওয়ালটনের সাড়ে নয়শ’ একরের বিশাল কারখানা ক্যম্পাসে প্রবেশ করেই এক বিস্ময়কর অনূভূতিতৈরি হয়। বিশাল এই ক্যাম্পাস ছিলো সবুজে ঘেরা পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন।যা যেকোনো শিল্পোন্নত দেশের কারখানার সঙ্গেই তুলনা করা চলে।

প্রায় ১৯ হাজার শ্রমিক কর্মচারির কর্মমূখরএই্ ক্যম্পাসের কোথাও কোনো অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চোখে পড়েনি। চারটি বড় আয়তনের কারখানা ভবন পরিদর্শন কালে বাথরুমগুলোর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ছিলো চোখে পড়ার মতো। অতিরিক্ত সহকারি পরিচালক মিল্টন আহমেদ জানালেন কারখানার প্রতিটি বাথরুম প্রতি দশ মিনিট পর পর পরিষ্কার করা হয়। হিসাব শাখার এক কর্মকর্তা জানান প্রতিদিন সকালে ২৫ হাজার ডিম লাগে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মচারির জন্য। আটটি গরু জবাই করা হয়।

টেলিভিশন , ফ্রিজ, লিফট, ল্যাপটপ, মোবাইলসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের জন্য ২৩টি বিশাল কারখানা ভবন রয়েছে এই ক্যাম্পাসে। কারখানার ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উৎপাদন প্রক্রিয়া চোখে দেখেন সিএমজেএফর সদস্যরা। পণ্যের কাঁচামাল তাপা,লোহা ইত্যাদি আমদানি করে এনে তা দিয়ে নিজেরাই মোল্ডিং করে বিভিন্ন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছেন কারখানার ইন্জিনিয়ার ও শ্রমিকরা। এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্র এক জায়গায় এনে তা সংযুক্ত করে তৈরি হচ্ছে টেলিভিশন, ফিজ, এসি মেশিন, ল্যাপটপ।উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর আলম সরকার জানান প্রতি তিন মিনিটে ১০টি করে ফ্রিজ উৎপাদন হয়। প্রতিদিন বিভিন্ন মডেলের ৬ হাজার মোবাইল উৎপাদন করা হয় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য। বর্তমানে প্রতিদিন ওয়ালটন মোবাইলের চাহিদা ২০ হাজার পিস। এ জন্য আরেকটি কারখানা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।তিনি জানান বর্তমানে ওয়ালটন দেশের চাহিদা পূরণ করে ৪০টির বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। বিশ্বের নামিদামি অনেক কোম্পানি তাদের ইলেক্ট্রিক পণ্য তৈরি করছে। এরমধ্যে ভারতের রিলায়েন্স, জার্মানির বস বন্ডও পণ্য তৈরি করছে ওয়ালটন থেকে।

রবিবার সকাল ১১টা থেকে বেলা দেড়টা পযন্ত সরেজমিন পরিদর্শন শেষে কারখানার প্রধান কার্যালয়ে এসে সাংবাদিকদের মতামত শোনেন ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেননির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিমসহ কারখানার অন্যান্য কর্মকর্তা।শিল্প গ্রুপ ওয়ালটনের আরও দুটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসবে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিম। কোম্পানি দুটি হলো ওয়ালটন ডিজিটেক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও ওয়ালটন প্লাজা।

সংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে উদয় হাকিম বলেন, ‘এটা আমরা জানি যে ওয়ালটন সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য স্বল্প শেয়ার নিয়ে পুঁজিবাজারে এসেছে। এজন্য ওয়ালটনের আরও দুটি সহযোগি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে।’ ওয়ালটনের দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশি শেয়ার রাখা হবে বলেও জানান উদয় হাকিম।

২০২০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের মোট শেয়ারের মাত্র দশমিক ৫৩ শতাংশ শেয়ার বর্তমানে রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার। বাকি ৯৯ দশমিক ০৩ শতাংশ শেয়ার আছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ওয়ালটন পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এর মধ্যে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৬০ কোটি ৯৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮০৫ টাকা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩৯ কোটি ৩ লাখ ৪২ হাজার ১৯৫ টাকা সংগ্রহ করে।

সংগৃহীত টাকা থেকে ৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয় করা হয়েছে। ৩৩ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে কোম্পানিটি।

সিএমজেএফের সদস্যদের পরিদর্শনের শুরুতে ও শেষে এক সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পর্বে উদয় হাকিমের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কোম্পানির উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর আলম সরকার, হুমায়ুন কবির, কোম্পানি সেক্রেটারি পার্থ প্রতিম দাস, মিডিয়া উপদেষ্টা এনায়েত ফেরদৌস, মিল্টন আহমেদ সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তৃতা করেন ইকোনোমিকস রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি শারমিন রিনভী, সিএমজেএফ’র সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল, সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন, সাবেক সভাপতি জিয়াউর রহমান ও তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু। উপস্থিত ছিলেন সহ-সভাপতি এম এম মাসুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম এ কালামসহ সংগঠনের সদস্যরা।

পরিদর্শন শেষে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের( ইআরএফ) সভাপতি শারমিন রিনভী বলেন, ‘ওয়ালটনের মতো এত বড় ও সুন্দর আরও কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বাংলাদেশ দ্রুতই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাবে।’

সিএমজেএফের সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল বলেন, ‘ওয়ালটন এক বিস্ময়। এতদিন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে শুধু পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে সবাই চিনতো। এখন বাংলাদেশে তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওয়ালটনের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। কারখানা পরিদর্শনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের পেশাগত দক্ষতা যেমন আরও বাড়বে, তেমনই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সুসম্পর্কও গড়ে উঠবে।’

সিএমজেএফের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন বলেন, ‘ওয়ালটন কল্পনার চেয়েও অনেক বড়। ওয়ালটন ফ্যাক্টরি এত বড়, যা এক দিনে দেখে শেষ করা যাবে না। ওয়ালটনের করপোরেট কালচারও খুব সুন্দর।‘ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে ওয়ালটন অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।

ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানা পরিদর্শনে সময় প্রোডাক্ট ডিসপ্লে সেন্টারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রেফ্রিজারেটর দেখেন সিএমজেএফের নেতারা।

অতিথিরা সকালে কারখানায় পৌঁছলে তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়।কারখানা প্রাঙ্গণে পৌঁছে অতিথিরা প্রথমে ওয়ালটনের বিশাল কর্মযজ্ঞের ওপর নির্মিত ভিডিও ডকুমেন্টারি উপভোগ করেন। তারা ওয়ালটনের সুসজ্জিত প্রোডাক্ট ডিসপ্লে সেন্টার পরিদর্শন করেন। এরপর সাংবাদিকরা রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, টেলিভিশন, কম্প্রেসর, মোল্ড-ডাই ইত্যাদি উৎপাদন ইউনিটসহ বিভিন্ন পণ্যের গবেষণা ও উন্নয়ন সরেজমিন দেখেন।

৩০ জুন অর্থবছর শেষ হওয়া ওয়ালটন তার শেয়ারধারীদের ২০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করেছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২৮ মার্চ, ২০২১)