অস্থির শেয়ারবাজার:অন্যরা যখন নরম, তখন কঠোর বিএসইসি
আব্দুল্লাহ শুভ,দ্য রিপোর্ট:পুঁজিবাজারের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) যেন একটু বেশিই কঠোর। অভিভাবকসূলভ আচরণ থেকে বের হয়ে কমিশন এখন তালিকাভূক্ত বা তালিকাভূক্ত হতে চাওয়া কোম্পানিগুলোকে নানা শর্তে ফেলে কোম্পানিগুলোর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার কাজটি জোরালো ভাবেই করছে বলে মত অনেকের। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদেরকে।
দেশের অন্যান্য আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো-বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর নমনীয় আচরণ করলেও বিএসইসি উল্টো পথে হাটছে।বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর আরোপিত শর্ত পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। করোনা পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোকে সাপোর্ট না দিয়ে আরও বেকায়দায় ফেলার সব চেষ্টাই যেন করছে কমিশন।
এদিকে,দেশের আর্থিক খাতের সর্বোচ্চ অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংক,করোনা পরিস্থতিতে ঋণ খেলাপীর সঙ্গা যেন বদলে ফেলেছে। করোনার এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে - ‘ এ অবস্থায় ঋণ পরিশোধ না করতে পারলেও ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ খেলাপি বলা যাবে না’। গতবছর করোনার প্রভাবে যখন সকল খাতে অস্থিরতা শুরু হয় তখনও এমন ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে অর্থনীতির প্রবাহ ঠিক রাখতে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতে বলা হয়েছে –‘যেসব ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলমান ঋণের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে এবং নতুন করে নবায়ন করা হয়নি, সেসব ঋণের শুধু সুদ পরিশোধ করলেই চলবে। তবে তা ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত নিয়মিত রাখতে হবে। এসব গ্রাহকের কারো গত বছরের সুদ বকেয়া থাকলে চলতি মাস থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ছয়টি ত্রৈমাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে। যেখানে চলতি ঋণের কিস্তি মাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ করতে হতো সেখানে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আরোপিত সুদও ত্রৈমাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
করোনায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বহির্বিশ্বেও মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় রফতানি বাণিজ্য কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা এবং একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে ঋণ প্রবাহের গতিধারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে নতুন নির্দেশনা দেয়া হলো’।কেন্দ্রিয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে অস্থিরতা কমাবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে, বিএসইসি তালিকাভূক্ত কোম্পানি এবং আগ্রহী কোম্পানির উপর একের পর এক শর্ত আরোপ করে যাচ্ছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সব সময় ওই কোম্পানির ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা এবং সতন্ত্রভাবে প্রত্যেক পরিচালকদের হাতে ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে কমিশন। অথচ বাজার বিশ্লেষকদের বড় একটি অংশ এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দিলেও এ বিষয়ে কমিশন কোন কর্ণপাত করেনি। এ সিদ্ধান্তের ফলে বেশ কয়েকটি তালিকাভূক্ত কোম্পানিকে ভূগতে হচ্ছে এবং অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে পারছে না।
এর ফলে পুঁজিবাজারে আসার দরজা অনেক ভাল পারফরমেন্স করা প্রতিষ্ঠানের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক পরিচালক। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ সিদ্ধান্তের নেতিবাচক দিকটাই বেশি । তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার শর্ত ইতিবাচক হলেও সতন্ত্র পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার থাকার সিদ্ধান্তটি আমার মনে হয় অত-শত চিন্তা করে দেওয়া হয়নি। কারণ, কোন কোম্পানির যদি ২০ জন পরিচালক থাকেন, তারা যদি প্রত্যেকে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেন তাহলে তো সম্মিলিতভাবে ৪০ শতাংশ হলো। বাকী ১০ শতাংশের মালিকানা কে নেবে। আবার বিপরীত দিকের হিসাব করুন। একটি কোম্পানির ৭ জন পরিচালক রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেযদি ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেন তাহলে তো সম্মিলিতভাবে ১৪ শতাংশ হলো। ৩০ শতাংশ পুরলো না। তাহলে এই কম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে পারবে না। আবার তালিকাভুক্ত হলেও আইনী জটিলতায় পড়ে গেলো।তিনি বলেন- ‘এই সিদ্ধান্তটি আরও ভেবে চিন্তে নেওয়া উচিত ছিল।’
বারবার এসব বিষয়ে কমিশনকে অবহিত করা সত্বেও কমিশন সরাসরি নাকচ করার পাশাপাশি আরও নতুন শর্ত আরোপ করছে। সর্বশেষ শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো -কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে বোনাস লভ্যাংশ দেওয়ার বদলে নগদ লভ্যাংশ দেয়া। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদ্য তালিকাভূক্ত বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে আগামী ৫ বছর বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে। নতুন তালিকাভূক্ত কোম্পানিটি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে তালিকাভূক্তির আবেদন করে। আগামী ৫ বছর কোম্পানিটিকে নগদ লভ্যাংশ প্রদান করতে হলে কোম্পানিটি বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা হারাবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধার সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, কমিশন অবশ্যই চিন্তা ভাবনা করে এ শর্ত আরোপ করেছে। তবে, এ শর্ত বাস্তবায়নের ফলে কোম্পানিতে নতুন বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। বিনিয়োগযোগ্য বড় একটি অংশ যখন নগদ লভ্যাংশ প্রদানে চলে যাবে তখন কোম্পানি তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল নাও হতে পারে। তাছাড়া, বিনিয়োগকারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টিকে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবেনা। কমিশনের আরেকটু ভেবে-চিন্তে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিলো বলেও জানান তিনি।
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ই-জেনারেশনকেও একই শর্ত জুড়ে দিয়েছে কমিশন। কোম্পানিটিকে আগামী ৪ বছর নগদ লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে। এর ফলে কোম্পানিটির প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বিএসইসি যখন এমন সব কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তখন পুঁজিবাজারের প্রাথমিক মার্কেটের মতোই গতিহারা হয়ে পড়েছে সেকেন্ডারী মার্কেট। গত ১৪ দিনে এই বাজারের সুচক কমেছে ২৫৪ পয়েন্ট। গত দুই সপ্তাহে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ১৮ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। ক্রমাগত পতনে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। যদিও কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে‘বাজারের অবস্থা ভালই আছে।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম জানান, বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত কমিশন থেকে এসেছে। সোজাভাবে বলতে গেলে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই এমন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে বাজার বিনিয়োগবান্ধব হবে এবং বাজারে গতি বাড়বে বলেও জানান তিনি।
দ্য রিপোর্ট/এএস/৩০,মার্চ ২০২১