সেই প্রশান্ত ম্যাজিকেই মমতার জয়
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ভারতে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে অভাবনীয় সাফল্য পায় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বাংলাভাষী এই রাজ্যে লোকসভার ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয় পায় বিজেপি। অন্যদিকে, রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের আসন কমে দাঁড়ায় ২২টিতে। অথচ এর আগে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কোনো নিশানাই ছিল না। সেই নির্বাচনে রাজ্যে মমতার দলের প্রার্থীরা জিতেছিলেন ৩৪টি আসনে। দুই বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর অনেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা ছিল, বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি ঝড়ে হারিয়ে যাবে তৃণমূল কংগ্রেস।
তবে সবাইকে তাক লাগিয়ে মমতার দল শুধু তৃতীয় বারের মতো জয়ই পায়নি, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার ধারেকাছেও যেতে পারেনি বিজেপি। এর পেছনে মমতার ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতির পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশলকেই বাহবা দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।
গত দুই বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের এই কৌশলের পেছনের নায়ক পেশাদার কোনো রাজনীতিক নন, তিনি ভারতের আলোচিত নির্বাচন কৌশল প্রণয়নকারী (পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট) প্রশান্ত কিশোর।
লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর প্রশান্তের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে তৃণমূল। তার বেঁধে দেয়া নিয়মের মধ্যেই গত দুই বছর চলতে হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের।
প্রশান্তের কৌশলের অন্যতম ছিল বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের ‘বহিরাগত শক্তি’ হিসেবে প্রচার চালানো। তৃণমূলের প্রচারে ‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’ শ্লোগানও প্রশান্তের তৈরি করা।
নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রশান্ত কিশোর টুইটবার্তায় বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি দুই অঙ্ক ছাড়াতে পারবে না। শেষপর্যন্ত হয়েছেও তাই। এই রাজ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ১০০ ছুঁতে পারেনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
কে এই প্রশান্ত কিশোর?
ভারতের আলোচিত নির্বাচন কৌশল প্রণয়নকারী প্রশান্ত কিশোরের জন্ম ১৯৭৭ সালে। দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে সংক্ষেপে ডাকা হয় পিকে। পশ্চিমবঙ্গের আগে ভারতের আরও কয়েকটি রাজ্যে প্রশান্তকে নিয়োগ দিয়ে সাফল্য পেয়েছে অন্য কয়েকটি দল। এমনকি নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তার ইমেজ বাড়ানোর কাজও করেন এই প্রশান্ত।
ভারতের এই রাজনীতির চিকিৎসক অবশ্য কখনওই রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। অর্থের বিনিময়ে রাজনীতির দাওয়াই দেয়ার পেশায় নামার আগে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে আফ্রিকায় কাজ করেছেন প্রশান্ত। সেখানে আট বছর চাকরির পর ২০১১ সালে দেশে ফিরে আসেন; গড়েন সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নমেন্ট (সিএজি) নামে একটি সংস্থা।
২০১২ সালে গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির হয়ে ভোটের রণকৌশল প্রণয়ন করেন প্রশান্ত। গুজরাট দাঙ্গায় বিতর্কিত মোদির একেবারেই আলাদা ইমেজ তরুণদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মোদিকে জেতাতে উন্নয়নের সঙ্গে ঐক্যের বার্তা জুড়ে ব্যাপক প্রচারণা কৌশল তৈরি করেন প্রশান্ত।
মূলধারার গণমাধ্যমকে এড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশান্ত এমন প্রচারণা চালান, যাতে গুজরাট দাঙ্গার কালিমা মুছে গুজরাটে আবার ক্ষমতায় আসেন মোদি।
সেই সাফল্যের পর প্রশান্তকে জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব দেন মোদি। ভারতের ২০১৪ সালের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার কৌশল তৈরি করেন প্রশান্ত।
ওই সময়ই প্রশান্তের মাথা থেকে বের হয় ‘চায়ে পে চর্চা’, ‘রান ফর ইউনিটির’ মতো ধারণাগুলো। এতে ভর করে দেশজুড়ে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
এরপর ২০১৫ সালে বিহারের বিধানসভার ভোটে সংযুক্ত জনতা দলের নেতা নীতিশ কুমারকে জেতাতে ভূমিকা রাখেন প্রশান্ত। ওই সময় অঞ্চল ভাগ করে সেখানকার সমস্যা বুঝে নীতিশের বক্তব্য তৈরি করতেন প্রশান্ত। নীতিশের উপদেষ্টা হিসেবেও বেশ কিছু জনমুখী পরিকল্পনা হয় তার হাত ধরেই।
২০১৬ সালের পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের জয় নিশ্চিতেরও কারিগর ছিলেন প্রশান্ত।
তবে পরের বছরই উত্তর প্রদেশ বিধানসভার ভোটে তিনি ধাক্কা খান। সেবার কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করলেও সেটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
ওই নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসন পায় কংগ্রেস। প্রতিপক্ষ বিজেপি তিন শতাধিক আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
তবে সেবার প্রশান্তের কৌশলের অনেক কিছুই মানেনি কংগ্রেস। প্রশান্ত তখন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সরাসরি রাজনীতিতে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তবে তাতে রাজি হননি প্রিয়াঙ্কা।
প্রশান্তের ঝুলিতে ব্যর্থতা বলতে গেলে এই একটিই। ২০১৯ সালে তার কৌশল অনুসরণ করে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন জগনমোহন রেড্ডি।
গুজরাট, বিহার, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশের পর এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রশান্ত কাজ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে।
নির্বাচনে তৃণমূলের জয় নিশ্চিতের পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রশান্ত বলেন, ‘মোদির জনপ্রিয়তা মানে এটি নয় যে, বিজেপি সব নির্বাচনেই জিতবে।’
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে প্রশান্ত বলেন, ‘আমরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি। নির্বাচন কমিশন চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। এতে আমাদের প্রচার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। তবে আমরা যা করছি সে বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে তৃণমূল।’
প্রশান্তের সাফল্যের রহস্য নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, তার প্রথম হাতিয়ার রিসার্চ বা গবেষণা। প্রতিটি বুথ ধরে সমীক্ষা করে সেখানকার সমস্যা জেনে নেয়া এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা।
দ্বিতীয়ত, পেশাদারদের দিয়ে অভিনব প্রচার ও রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ বাতলে দেয়া। এর সঙ্গে পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা বুঝে সেই অনুযায়ী কৌশল সাজানো।
আনন্দবাজার লিখেছে, বিভিন্ন রকম সমীকরণ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং ঘাটতি দূর করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার পরিকল্পনা প্রশান্তের সাফল্যের চাবিকাঠি।
এর ব্যতিক্রম ছিল না পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনেও। প্রশান্তের পরামর্শে নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধা জানতে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি শুরু করে তৃণমূল।
‘দিদিকে বলো’র সাফল্যের পর দলের জনসংযোগ বাড়াতে চালু করা হয় ‘বাংলার গর্ব মমতা’ নামের প্রচার। ১১ ধাপে তিনটি পর্যায়ে ৭৫ দিন ধরে চলা চলা এ কর্মসূচিতে সাত প্রায় হাজার গ্রামে প্রচারণা চালান তৃণমূলের এক লাখ নেতা-কর্মী। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝান রাজ্যের উন্নয়নে মমতার অপরিহার্যতার বিষয়টি।
তৃণমূলে মমতা ছাড়া আর বিকল্প কোনো মুখ নেই। তাই তার কারিশমার ওপর ভিত্তি করেই কর্মসূচি সাজান প্রশান্ত।
প্রশান্তের সে প্রচারণা অনুযায়ী বাংলা তার নিজের মেয়েকেই বেছে নিয়েছে।
তবে এবারের কাজ শেষে ক্লান্তির সুর মিলেছে প্রশান্তের কণ্ঠে। এনডিটিভিকে তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচনি কৌশল প্রণয়নে আর থাকছেন না তিনি, তার একটি ব্রেক দরকার।
প্রশান্ত বলেন, ‘আমি যা করছি সেটি আর করতে চাই না। যথেষ্ট হয়েছে। এখন আমার বিশ্রাম ও জীবনে অন্য কিছু করা দরকার। আমি এই জায়গা ছেড়ে দিতে চাই।’
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০২ মে, ২০২১)