রিং সাইন কেলেঙ্কারি : জড়িতদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে ব্যবস্থা
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারের বহুল আলোচিত কোম্পানি রিং সাইন টেক্সটাইল কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও সিকিউরিটিজ আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সভাপতিত্বে ২৩ জুন অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কমিশন সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে রেজাউল করিম জানান, রিং সাইন নিয়ে বিএসইসির করা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। উদ্যোক্তা বা পরিচালক ও ৭৩ জন সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এই পরিশোধিত মূলধন ২৮৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। তবে ১১ জন উদ্যোক্তা বা পরিচালক এবং ৩৩ জন সাধারণ শেয়ারহোল্ডার এই শেয়ারের বিপরীতে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি।
এছাড়াও ২০১৭ সালের ৩০ জুন থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকাশিত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক চিত্র উঠে আসেনি বলেও জানান বিএসইসির মুখপাত্র।
তিনি জানান, কমিশন অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিজ আইন ও মানি লন্ডারিং (অর্থপাচার) আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে রিং সাইন টেক্সটাইল অপারেশনে (উৎপাদনে) রয়েছে এবং সক্ষমতার উন্নতি হয়েছে।
কাদের বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন এবং অর্থপাচার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০১৮ সালের ১২ মার্চ পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বস্ত্রখাতের প্রতিষ্ঠান রিং সাইনকে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার অনুমোদন দেয়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেয়ে প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা ক্রয়, ঋণ পরিশোধ এবং আইপিও খরচ খাতে ব্যয় করতে শেয়ারবাজারে ১৫ কোটি সাধারণ শেয়ার ছেড়ে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে।
আইপিওর কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেশ ছেড়ে যাওয়ার গুজবের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়। বিএসইসির অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবস্থা নিয়েছিল।
এর পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাওয়া উৎপাদন পুনরায় শুরুর মাধ্যমে ব্যবসার উন্নয়নে কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বিএসইসি। কোম্পানিটির অনিয়ম অনুসন্ধানে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এছাড়াও রিং সাইনের কেলেঙ্কারি তদন্তে ৬১টি বিও হিসাবের তথ্য তলব করে বিএসইসি।
এ পরিস্থিতিতে গত ২০ মে কমিশন সভা করে বিএসইসি রিং সাইনের আইপিও’র মাধ্যমে উত্তোলন করা অর্থের ৪০ কোটি টাকা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। সে সময় বিএসইসি থেকে জানানো হয়, এই অর্থ থেকে শ্রমিকদের অবসর ভাতা ১৫ কোটি টাকা, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের বকেয়া তিন কোটি টাকা, তিতাস গ্যাসের বকেয়া তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঋণ ১০ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ঋণ ছয় কোটি টাকা এবং বিবিধ খাতে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করা যাবে।
ওই কমিশন সভায় ন্যূনতম ৫১ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারের উপস্থিতিতে কোম্পানিটির আইপিওর অর্থ ব্যবহার পরিকল্পনা সংশোধন অথবা পরিবর্তনের ঘটনাত্তোর অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়।
এছাড়াও আইপিওতে আসার আগে রিং সাইন প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে যে টাকা উত্তোলন করেছে বলে দেখিয়েছে, তার মধ্য থেকে কোনো অর্থ জমা না হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর শেয়ার এবং তার বিপরীতে ইস্যু করা সকল বোনাস শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে কোম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয় কমিশন।
বিএসইসি শেয়ারবাজারে ১৫ কোটি সাধারণ শেয়ার ছেড়ে রিং সাইনকে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দিলেও আইপিও আবেদন গ্রহণের পর প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরপর দুটি পর্ষদ সভাতে কোম্পানিটির আইপিও অনুমোদন পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হয়, অস্তিত্বহীন ইউনিভার্স নিটিং কোম্পানির নামে রিং সাইন টেক্সটাইলের প্রায় ২৫ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। রিং সাইন টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ইউনিভার্স নিটিংয়ের চেয়ারম্যান পদে আছেন, যা অনৈতিক। এ বিষয়ে ডিএসই থেকে বিএসইসিতে একটি অভিযোগও দেয়া হয়। সেই সঙ্গে কোম্পানিটির তালিকাভুক্তিও আটকে দেয় ডিএসই।
কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর কমিশন সভা করে বিএসইসি জানায়, বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে রিং সাইন টেক্সটাইল নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য মিথ্যা। ইউনিভার্স নিটিং গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান সুং ওয়ে মিন রিং সাইন টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিষয়টি প্রসপেক্টাসের ১৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা আছে।
এছাড়াও ইউনিভার্স নিটিং কোম্পানির নিয়মিত পরিচালনায় সক্রিয় থাকার প্রমাণাদি কমিশনে পাঠায় রিং সাইন। এতে কোনো আইন লঙ্ঘন হয়নি। যাতে বিষয়টি সভায় ডিসক্লোজার ভিত্তিতে সমাধান হয়েছে- বলে জানায় বিএসইসি।
তবে শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে রিং সাইন টেক্সটাইলের এমডির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইউনিভার্স নিটিং গার্মেন্টস কর্তৃক রিং সাইনের ধারণ করা শেয়ারে এক বছরের পরিবর্তে তিন বছর লক-ইনের শর্তারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চাপাচাপিতে এক পর্যায়ে কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসই এবং ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে বছর না ঘুরতেই কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
তবে বিএসইসির নতুন কমিশন আসার পর চলতি বছরে পুনরায় উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে ব্যবসায় উন্নয়নের লক্ষ্যে কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সাত স্বতন্ত্র পরিচালক
রিং সাইনের পর্ষদ ভেঙে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। এই সাত স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন- পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মেজবাহ উদ্দিন (পিআরএল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ল্যাদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের অধ্যাপক মোহাম্মদ সগির হোসাইন খন্দকার, জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফোরোজ আলী, পাওয়ার গ্রিডের স্বতন্ত্র পরিচালক ইসতাক আহমেদ শিমুল এবং অ্যাভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেসের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ২৪ জুন, ২০২১)