আব্দুল্লাহ শুভ,দ্য রিপোর্ট:

উর্দুভাষী বা বিহারী বলতেই আমাদের কপালে রাজ্যের ঘৃণার দাগ ভেসে ওঠে। যদিও এর যৌক্তিক কারণও আছে ।১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের সাথে একজোট হয়ে বিহারীদের বড় একটি অংশ যেভাবে বাঙ্গালীদের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের) উপর  নির্যাতন চালায়, তাতে করে বাঙ্গালীদের বিহারীদের উপর ঘৃণাবোধ চলে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয়না তেমনি এসব উর্দুভাষী বিহারীদের সকলেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় শাসকগোষ্টির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। বরং নিজের ভাষা ‍উর্দু হওয়া স্বত্ত্বেও ১৯৫২ সালে যেমন তারা বাংলা ভাষার জন্য গলা ফাটিয়েছেন, রাজপথ কাঁপিযেছেন তেমনি, ১৯৭১ সালে নির্যাতিত বাঙ্গালীদের পাশে দাড়িয়ে শাসকগোষ্টির বিরাগভাজন হয়েছেন।

 

 

 

জয়নুল আবেদিন তাদেরেই একজন।জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন উর্দুভাষী।বাস্তবতা মেনে চললে তার থাকার কথা ছিল পাকিস্তানে, নিজের পরিবার পরিজনদের সাথে। তবে আপন শাখা-প্রশাখাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার প্রেমে, বাংলাদেশের প্রেমে এতটাই মজে ছিলেন যে, শেষমেষ পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে।একজন উর্দুভাষী হয়েও বাংলাভাষাকে বাঙ্গালীদের মাতৃভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করেছেন রাজপথে। বাংলা ভাষার সমর্থনে উর্দুতে ব্যানারে পোষ্টারে লিখে ঢাকায় বসবাসরত উর্দুভাষীদেরকে বুঝিয়েছেন বাংলা ভাষার মাহাত্য। তাদের সমর্থন জুগিয়েছেন। গলা ফাটিয়ে বলেছেন, ‘হামার জবান, বাংলা জবান’।

যে মানুষটা উর্দুভাষী হয়েও বাংলা ভাষাকে, ভিনদেশী হয়েও বাংলাদেশকে ভালবেসে, পরিবার পরিজন ছেড়ে, এদেশেই সারাটা জীবন উৎসর্গ করলেন, জীবদ্দশায় গুটি কয়েক লোক বাদে তার খোজ কেউ নেয়নি। । রাষ্ট্র এক্ষেত্রে ভুলে গিয়েছিল অতীত। আশ্রয় বলতে ছিল প্রেসক্লাব। প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য ছিলেন। প্রেসক্লাবেই থাকতেন। অন্যান্য সদস্যদের জন্য প্রেসক্লাব দ্বিতীয় আবাস হিসেবে পরিগনিত গলেও তার কাছে প্রেসক্লাবই ছিল প্রথম আবাস। এমনকি তার পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে লেখা ছিল ১৮/তোপখানা(প্রেসক্লাব)।এভাবে চলতে চলতে একসময় অভিমান জন্মে জয়নুলের মনে।। ভাষা আন্দোলনে অবদানসরুপ একমাত্র প্রেসক্লাবই জানিয়েছিল সম্মান,২০১৪ সালে। প্রাপ্তি বলতে ওইটুকুই।এভাবে চলতে চলতে হয়ত একসময় অভিমান জন্মে জয়নুলের মনে। শেষে হয়ত ওই অভিমান সাথে নিয়েই গত ৯মার্চ বাংলাদেশপ্রেমী জয়নুল আবেদিন পাড়ি জমান না ফেরার দেশে, নি:শব্দে।

তার সম্পর্কে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ তার ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ গ্রন্থে লিখেছেন’ ‘তিনি অবাঙ্গালী হয়েও বাংলাভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন।পরিবারেরসবাইপাকিস্তানেচলেগেলেওতিনি বাংলায় থেকে গেছেন বাংলারটানে;একা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় এ কর্মী উর্দুতে দেয়াল লিখন ও বিভিন্ন উদ্দিপনামূলক উক্তি ও শ্লোগান লিখে ঢাকায় বসবাসরত উর্দুভাষীদের বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করেছিলেন এবং বাংলার পক্ষে জনমত গঠন করেছিলেন’।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি পুর্ব পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। পাকিস্তান সরকার তা টের পেয়ে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করে। জাতীয় প্রেসক্লাবে সদ্য আবিষ্কৃত স্যুভেনিয়রে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার হাস্যজ্জল ছবি দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু তার সাথে সরাসরি কথা বলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে নাগরিত্ব চান এবং পাকিস্তানে থাকা তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে নাগরিকত্ব দেন এবং পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেন।

জয়নুল আবেদিন ১৯৩৭সালেতৎকালীনব্রিটিশভারতেরউত্তরপ্রদেশেরএলাহাবাদেএকসম্ভান্তমুসলিমপরিবারেজন্মগ্রহণকরেন।মুহাম্মদগোলাম মোস্তফাও মা জয়তুন বেগমের চার পুত্রকন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা একজন ধর্মীয় পন্ডিত ছিলেন। মহররম মাসে জন্মেছিলেন বলে বাবা তার নাম রেখেছিলেন জয়নুল আবেদিন।বাবা ইস্টইন্ডিয়ানরেলওয়ের হেডড্রাফটসম্যানহিসেবেকর্মরতছিলেন বিধায় তার শৈশবকেটেছেবিহারে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তার বাবা পূর্বপাকিস্তানরেলওয়েতেযোগদেন।নতুনকর্মস্থলহয়সৈয়দপুরে।সৈয়দপুরে মেট্রিকুলেশনপড়ার সময়ই মাকে হারান জয়নুল।বাবা অধিকাংশ সময় কাজে থাকায় ছোট ভাইদের দায়িত্ব নিতে হয় নিজ কাধে। স্কুলে থাকা অবস্থাতেই জয়নুল তখনকার গোপনকমিউনিস্টপার্টিতেজড়িয়ে পড়েন।পরে ঢাকায় এসে ঢাকাকলেজথেকেআইকমও জগন্নাথ থেকে বি কমএবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন।এরপর ১৯৫৭সালেউর্দু দৈনিক‘জং’ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিক জীবনের সুত্রপাত ঘটে তার।পরেবাংলাদেশের বেশ কিছু জনপ্রিয় দৈনিক যেমন,মর্নিংনিউজ,বাংলাদেশটাইমস,চিত্রালী,ওয়াতনও সংবাদসংস্থাএনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেকাজকরেছেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘জং’এরবাংলাদেশপ্রতিনিধিহিসেবেকাজকরেছেন তিনি।

জয়নুল আবেদিন অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বলে জানিয়েছেন জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্টজন, হলিডে পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি ও রেডিও তেহরানের বাংলাদেশ প্রতিনিধি আব্দুর রহমান খান।জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জয়নুল আবেদিন আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মত ছিলেন।ক্ষোভের কারণেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক,সারাজীবন বিয়ে করেননি তিনি। পরিবারেরই অন্যান্যরা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না তার। আমার পরিবারকে তিনি নিজের পরিবার বলে মনে করতেন। খেতে ভালবাসতেন। হাজির বিরিয়ানী খুব পছন্দ করতেন। আমি তার কাছ থেকে উর্দু গজলের অর্থ বুঝে নিতাম আর মীর্জা গালিবের গজল,বাহাদুর শাহের গজলসহ ক্লাসিকাল গজলের তালিম নিতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা গজল বাজাতেন তিনি। এসব গজলের গুঢ় অর্থ আমাদের কাছে তুলে ধরতেন। অসাধারণ মানবিক গুনাবলীর অধিকারী জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশকে, বাংলা ভাষা,রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। তিনি বাংলাদেশকে নিজের মাতৃভূমি বলে মনে করতেন।জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন ভাল বন্ধুকে হারালো আর আমরা হারালাম একজন আপনজনকে’।

জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান বলেছিলেন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বাংলাদেশকে ততটা ভালবাসতে পারিনি যতটা জয়নুল আবেদিন পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে নিজের দেশ হিসেবে মনে করতেন। তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি সর্বদা স্মরনীয় হয়ে থাকবেন।

অনলাইন পোর্টাল দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোরের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, দূর্ভাগ্যজনকভাবে তার সাথে সেভাবে মেশার সুযোগ হয়নি আমার ।তবে তার সম্পর্কে যতটা জেনেছি তাতে চেনা মানুষদের চেয়েও চেনা মনে হয়েছে তাকে।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধু গত ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা বাড়লে ২০১৭’র ১৫ ফেব্রুয়ারী তাকে সরকারী কর্মচারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে লিভারে সমস্যা ধরা পড়লে ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে লিভার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। যে তারিখে বাংলা ভাষাকে মায়ের ভাষা করার দাবিতে তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস- সেই ২১ তারিখেই তিনি চিরতরে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বেশ কয়েকদিন এ অবস্থায় থেকে গত ৯মার্চ সহকর্মীদেরকাছে‘ঝনুভাই’নামেপরিচিত জয়নুল আবেদিন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। শুক্রবার(১০মার্চ)মিরপুরেবুদ্ধিজীবীকবরস্থানে তাকেদাফনকরা হয়।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

সোমবার (১৩মার্চ) বাদ আছর জাতীয় প্রেসক্লাবে তার স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ অনুষ্ঠানে দৈনিক সমকালের সম্পাদক ও জয়নাল আবেদিনের বন্ধু গোলাম সারওয়ার, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহানসহ প্রেসক্লাবের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা জয়নুল আবেদিনের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। পরে ঢাকা প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে জয়নুল আবেদিনের পরিবারের কাছে একটি শোকবার্তা পাঠানো হয়।

মাহফিলে গোলাম সারওয়ার বলেন, জয়নুল আবেদিন তাদেরই একজন,যারা ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তিনি আমার ঘনিষ্টজন ছিলেন।তার মৃত্যুতে আমি একজন বন্ধুকে হারিয়েছি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই সিরাজউদ্দিন। ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরই তিনি পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসেন। মিলাদ মাহফিলে সংক্ষিপ্ত কথামালায় তিনি বলেন, আমি এখন বুঝতে পেরেছি, জয়নুল আবেদিন কেন এই প্রেসক্লাব,এই দেশে ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান নি।

মঙ্গলবার (১৪মার্চ)কমনওয়েলথ জানালিস্ট বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের উদ্যেগে ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভায় জয়নুল আবেদিনের স্মরণে ১ মিনিট নিরবতা পালন করে তার প্রতি সম্মান জানানো হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।

আগামী শনিবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি জয়নুল আবেদিন স্মরণে একটি স্মরণসভার আয়োজন করবে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মহান এই বন্ধুকে সম্মান জানানো হলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি ।জীবদ্দশায় দেওয়া হয়নি কোন সুবিধা। অসুস্থ থাকাকালীন চিকিৎসার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করা হলেও সেখান থেকে কোন সাড়া আসেনি। এ নিয়ে জয়নুল আবেদিন সামান্য অভিমান করলেও আক্ষেপ করেননি কখনো্। বারবারই বলেছেন, ‘যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য জীবন দেয় সে দেশেরমানুষের সাথে আছি,চলতে পারছিএটাইতো অনেক।এটা তো ভাগ্যের ব্যপার’।

#....... এএস/দ্যরিপোর্ট

( ১৪ মার্চ ২০১৭ )