দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ২২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুক্রবার কারখানার ভেতর থেকে ৪৯টি মরদেহ বের করে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে। ভেতরে আরো মরদেহ আছে কিনা তা খোঁজ করছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

মর্মান্তিক এ মৃত্যুতে দীর্ঘ সময়ে আগুনে পুড়ে নিহতদের দেহের শুধুমাত্র হাড় ও কঙ্কাল ছাড়া বাকি সব পুড়ে গেছে। লাশগুলো উদ্ধার করতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। অনেকেও কেঁদেছেন এ লাশ দেখে। কারখানার ভেতর থেকেই লাশগুলো ব্যাগে করে বের করা হয়। বাইরেও কাউকে দেখতে দেয়া হয়নি লাশের এ চিত্র।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত বলেন, ইতোমধ্যে ৪৯টি মরদেহ ফায়ার সার্ভিসের ৫টি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সেখানে পরিচয় শনাক্তের পর লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ওই কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ডেমরা, কাঞ্চনসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ২২ ঘণ্টা চেষ্টা চালানোর পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও এখনও কোথাও আগুন আছে কিনা দেখা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ডাম্পিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে।

পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি:

এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন রূপগঞ্জের ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান, নারায়ণগঞ্জ জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন, পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং কলকারখানা অধিদপ্তরের জেলার একজন কর্মকর্তা।

স্বজনদের ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগের অনুরোধ:

স্বজনদের ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর অব অপারেশন লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমান বলেন, যাদের স্বজনদের খোঁজ পাচ্ছেন না তাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগ করবেন। জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এটি আমাদের অনুরোধ। সেখানে আমাদের জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ সকলের প্রতিনিধি থাকবে। সেখানে আমাদের আনুসাঙ্গিক নিয়মাবলী পালন শেষে লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে আমাদের কাজ শুরু হয়। এখনো আমাদের কাজ চলছে। রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে আমরা আগুন কমিয়ে আনি। পরে আবার বেড়ে যায়। এখানে গোডাউন ছিল এবং প্রতিটি ফ্লোরে কাঁচামালে বোঝাই ছিল। আমরা এখন পর্যন্ত ৪৯টি লাশ উদ্ধার করেছি।

জিল্লুর রহমান বলেন, ভেতরে অনেক জটলা থাকায় আটকে পড়ারা দ্রুত বের হতে পারেননি। এক্সিটের দিকে আগুন থাকায় কেউ বের হতে পারেনি। ২৫ জনকে আমরা জীবিত উদ্ধার করি এবং যারা মারা গেছে তাদের এক্সিটে আগুন থাকায় কেউ ছাদেও যেতে পারেনি, নামতেও পারেনি। ৫ তলা ৬ তলায় আমাদের তল্লাশি চলমান রয়েছে। সেখানে লাশ থাকতেও পারে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন:

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেছেন, আইজিপির নির্দেশনায় আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছি। কারখানার বিরুদ্ধে যে এত অভিযোগ, এগুলো এতদিন আমাদের এখানে আসেনি। এখন এসেছি, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হবে এবং যদি অন্য কোনো বিষয় থাকে সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। এ ঘটনায় মামলা হবে, মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।

শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন:

শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুস কারখানায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ৭ তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচতলার একটি ফ্লোরের কার্টন থেকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত ঘটে। এক পর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কালো ধোয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করে। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। আবার কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন। অনেকেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

শ্রমিকদের স্বজনদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, আনসারদের অস্ত্র লুটের অভিযোগ:

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ শ্রমিকদের খোঁজ করতে এসে ভিড় করা স্বজনদের সরাতে পুলিশ ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ বেধে যায়। দু’পক্ষের সংঘর্ষ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। স্বজনরাও ইট-পাটকেল ছোড়ে।

সংঘর্ষের সময় কারখানার আনসার ক্যাম্প থেকে আনসার সদস্যদের অস্ত্র লুটের অভিযোগ করেছেন তারা। যদিও এ ব্যাপারে কেউ সরাসরি বক্তব্য দিতে চাননি। তবে তারা আশেপাশের ডোবা ও বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রের খোঁজে পুলিশের সহযোগিতায় তল্লাশি করছেন।

নাম না প্রকাশ করে এক আনসার সদস্য বলেন, আমাদের ক্যাম্প থেকে ৩টি শর্টগান লুট হয়। পরে পাশের পুকুর থেকে দুটি উদ্ধার করা হয়েছে। আরেকটির খোঁজে তল্লাশি চলছে।

তৈরি হচ্ছে নিখোঁজদের তালিকা:

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজদের তালিকা প্রস্তুত করছে উপজেলা প্রশাসন। ভেতরে জীবিত কেউ থাকায় সম্ভাবনা কম। নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন কারখানার শ্রমিক নোমান মিয়া ওরফে ইয়াসিন, নাজমা বেগম, মোহাম্মদ আলী, জিহাদ রানা, সেলিম, ফারজানা, নাজমুল, তাসলিমা, মহিউদ্দিন, শামীম, রমেজা, ফিরোজা বেগম, নাঈম, শাহিদা, চম্মা বর্মণ, জাহানারা, হালিমা, তাসলিমা (২), পারভেজ, আকাশ, রাসেদ, হাসান, ইউসুফ, বাদশা, জিহাদ, শাকিল, রাকিব, রাকিব ২, মাহবুব, ফাতেমা আক্তার, হিমা, শাহানা, স্বপন, আমেনা, মিনা খাতুনসহ প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন।

আগুনে দগ্ধ ও ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন যারা:

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুনে দগ্ধ ও ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত স্বপ্না, মানিক, আশরাফুল, সুমন, সজিব, মেহেদী, মুন্না, মাজেদা, রুমা, মনোয়ারা, নাদিয়া, আছমা, মারিয়া, রুজিনা, সুমা, শফিকুল, সুফিয়া, সুজিদা, পারুল, রওশন আরা, শ্যামলাকে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ ইউএস-বাংলা হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এছাড়া নাহিদ, মঞ্জুরুল ইসলাম, মহসীন হোসেন, আবু বকর সিদ্দিক, আমেনা বেগম ও ফাতেমা আক্তারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

আহত আবু বকর জানান, কারখানায় আগুন লাগার পর বাঁচার জন্য ভবন থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। তখনই আহত হন।

আগুন নেভাতে বিলম্ব, যা বলছে ফায়ার সার্ভিস:

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল ভোরের দিকে। কিন্তু সকালে আবারো বেড়ে যায় আগুন। আমরা কাজ করেছি। পুরো কারখানায় ছিল অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ। আমরা যখনি আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনি তখনি আবারো আগুন বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, কেমিক্যালের দাহ্য পদার্থের কারণে এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে দেরি হয়েছে। মূলত এই দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে এবং হতাহত হয়েছে। দাহ্য পদার্থে আগুন দ্রুত ছড়ায়। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে এখানে দোষ কার খুঁজে বের করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ০৯ জুলাই, ২০২১)