দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: দীর্ঘ ১৪ বছর পর হতে চলেছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে হাইভোল্টেজ ফাইনাল মহারণ। কোপা আমেরিকা ফুটবলের ৪৭তম আসরের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা।

দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর এই লড়াইকে ঘিরে বিশ্ব ফুটবল এখন আবেগের জোয়ারে ভাসছে। একদিকে লিওনেল মেসি, অন্যদিকে নেইমার। কার হতে উঠবে মহাদেশীয় এ টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক? সে উত্তর জানতে কৌতূহলী সবাই।

বিষয়টা ফুটবল বলেই এ কৌতূহল তৈরি করছে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল বলে কথা। যে দু দলের বৈরিতা চিরকালীন। আর বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মানেই তো ফুটবল ভক্তদের দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া।

ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবারও। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ম্যাচটি ঘিরে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি তা আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমেও ঠাঁই পেয়েছে।

ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে ফুটবল দুনিয়ার সবচয়ে উত্তাপ ছড়ানো ম্যাচটি মাঠে গড়াবে বাংলাদেশ সময় রবিবার সকাল ৬টায়। ঘরের মাঠে টানা দ্বিতীয় ও নিজেদের দশম কোপা জয়ের মিশনে নামছে রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। টুর্নামেন্টের ১০৫ বছরের ইতিহাসে সেলেসাওরা এবারসহ ২১ বার ফাইনাল খেলছে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা এর আগে ২৮ বার ফাইনাল খেলে কোপা জয় করেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪ বার। এবার নিজেদের ২৯তম ফাইনালে সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ে উরুগুয়েকে ছোঁয়ার সুবর্ণ সুযোগ আলবিসেলেস্তাদের। সেমিফাইনালে ব্রাজিল ১-০ গোলে পেরুকে হারিয়ে ফাইনাল মঞ্চে পা রেখেছে। আর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর কলম্বিয়াকে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়ে রঙিন এই মঞ্চে উঠে এসেছে আর্জেন্টিনা।

মহারণের আগে সঙ্গত কারণেই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের দ্বৈরথ ও পরিসংখ্যান সামনে চলে আসছে। সবদিক বিবেচনায় স্পষ্ট ফেবারিট হয়েই ফাইনাল খেলবে কোচ তিতের দল। এর আগে ব্রাজিলে যে পাঁচবার কোপার আসর হয়েছে তার প্রতিটিতেই শিরোপা জিতেছে সেলেসাওরা। এবারও ঘরের মাঠে অপরাজেয় রেকর্ড অক্ষুণœ রাখতে চায় সাম্বা ছন্দের দেশ। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে পরিসংখ্যানেও অনেক এগিয়ে পেলের দেশ। কোপায় দু’দলের লড়াইয়ে সর্বশেষবার আর্জেন্টিনা যখন জিতেছিল, মেসি তখন হাঁটি হাঁটি পা পা করছেন। সেটা এখন থেকে ৩০ বছর আগের ঘটনা। সেবার দিয়াগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা জিতেছিল ৩-২ গোলে। কিন্তু সেটা আসরের ফাইনাল ম্যাচ ছিল না। সেবার দুই গ্রুপের সেরা চারটি দল নিয়ে হয়েছিল ফাইনাল রাউন্ড। সেখানে ১৭ জুলাই ১৯৯১ সালে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা।

কোপার ফাইনাল বিবেচনা করলে দল দু’টি এবারের আগে মুখোমুখি হয়েছে ১৯৩৭, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। ৮৪ বছর আগে আবশ্য টুর্নামেন্টের নাম কোপা আমেরিকা ছিল না। তখন দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ নামে খেলা হতো। সেবার রাউন্ড রবিন লীগ সিস্টেমে খেলা টুর্নামেন্টের সেরা দুই দল হিসেবে ফাইনালে খেলেছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ওই টুর্নামেন্টে অবশ্য ফাইনাল খেলা হতো না; যদি না দুই দল সমান পয়েন্ট নিয়ে লীগপর্ব শেষ করত। সেবার লীগপর্ব দু’দল সমান্তরালে শেষ করায় শিরোপা নির্ধারণী প্লেঅফ ম্যাচ হয়েছিল। যেখানে অতিরিক্ত সময়ের লক্ষ্যভেদে ২-০ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা।

এর পরের ইতিহাস শুধুই ব্রাজিলের। কোপাতে দুইবার ও ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে একবারসহ টানা তিন ফাইনাল লড়াইয়ে বিজয়ীর হাসি হেসেছে সাম্বা ছন্দের দেশ। ২৫ জুলাই ২০০৪ সালে পেরুতে অনুষ্ঠিত কোপার ফাইনাল ২-২ গোলে ড্র হওয়ার পর টাইব্রেকারে দ্বিতীয় সারির ব্রাজিল জিতেছিল ৪-২ গোলে। এরপর ভেনিজুয়েলায় হওয়া ২০০৭ সালের ১৫ জুলাইয়ের ফাইনালেও দ্বিতীয় সারির ব্রাজিলের কাছে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল পূর্ণশক্তির আর্জেন্টিনা। এর মাঝখানে ২০০৫ সালের ২৯ জুন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে হওয়া ফিফা কনফেডারেশন্স কাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে ট্রফি জিতেছিল রোনাল্ডিনহোর ব্রাজিল। এবার কোপার ইতিহাসে চতুর্থ আর সবমিলিয়ে পঞ্চম ফাইনালে কোন্ দল বাজিমাত করে সেটা দেখতে সবার চোখ এখন মারাকানায়।

১৯৯১ সালের পর আর্জেন্টিনা তাদের চিরপ্রতিন্দ্বীদের বিরুদ্ধে কোপায় খেলেছে ছয়বার। কিন্তু হেরেছে সবগুলো ম্যাচেই। তবে এবার ইতিহাস বদলাতে মরিয়া আর্জেন্টিনা। তারাও যে ১৯ ম্যাচে অপরাজিত আছে। সর্বশেষ আর্জেন্টিনা হেরেছিল এই ব্রাজিলের কাছেই। সেটা ২ জুলাই ২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে। ওই ম্যাচ ২-০ গোলে জিতে ফাইনালে ওঠার পর চ্যাম্পিয়নও হয় বিখ্যাত হলুদ জার্সিধারীরা। এরপর ২০১৯ সালের ১৫ নবেম্বর দু’দলের সর্বশেষ দেখায় আর্জেন্টিনা সুপার ক্লাসিকো জিতেছিল ১-০ গোলে। কোপায় দীর্ঘ ৩০ বছর ব্রাজিলকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। তবে প্রাচীন এই আসরে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে জয়ের পাল্লা ভারি আকাশী জার্সিধারীদেরই। দু’দলের ৩৩ লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার ১৫ জয়ের বিপরীতে ব্রাজিলের জয় ১০টিতে। বাকি ৮ ম্যাচ ড্র হয়। সবধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে আবার এগিয়ে ব্রাজিল। এ পর্যন্ত ১১১ দ্বৈরথে ব্রাজিলের ৪৬ জয়ের বিপরীতে আর্জেন্টিনার জয় ৪০ ম্যাচে। ২৫ ম্যাচ ড্র হয়েছে।

তবে পরিসংখ্যান নিয়ে ভাবছে না কোন দলই। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার লক্ষ্যে মাঠে নামছে ব্রাজিল। দলটির সেরা তারকা নেইমার তার ক্যারিয়ারে প্রথম কোপা শিরোপা জিততে বদ্ধপরিকর। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা এই ফরোয়ার্ড পাঁচ ম্যাচে দুই গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছে আরও তিনটি। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ও দলটির অধিনায়ক লিওনেল মেসি মাঠে নামছেন তাদের দীর্ঘ শিরোপা খরা ঘোচানোর লক্ষ্যে। স্বর্ণালি ক্যারিয়ারে ক্লাব বার্সিলোনার হয়ে সব ট্রফি জিতলেও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে এখনও কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা জিততে পারেননি রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফাসেরা তারকা। পারবেন কি করে। আর্জেন্টিনা যে সেই ১৯৯৩ সালে কোপা জয়ের পর আর কোন আন্তর্জাতিক ট্রফি জিততে পারেনি। এবার দীর্ঘ ২৮ বছর পর আরেকবার হাহাকার ঘোচানোর সুযোগ মেসির সামনে।

এ টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে চলা ক্ষুদে জাদুকর মনেপ্রাণে চাচ্ছেন স্বপ্নের ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে। ফাইনালের আগে ছয় ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ চার গোল ও পাঁচ এ্যাসিস্ট করেছেন মেসি। ব্রাজিলের বিরুদ্ধেও অপ্রতিরোধ্য এ ধারা ধরে রাখতে চান আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। এখন দেখার মারাকানায় দুই বন্ধু মেসি ও নেইমারের প্রথম ফাইনাল সাক্ষাতে কে হাসেন শেষ হাসি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ১০ জুলাই, ২০২১)