সামাজিক বৈষম্যের বেদীতে বলি এক চিত্রনায়িকা পরীমনি
সাকিলা মতিন মৃদুলা : হঠাৎ করেই চলচিত্রের নায়িকা পরীমনিকে আটক করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব অভিযান চালিয়েছে তার বাড়িতে। অভিযানের আয়োজন দেখে মনে হয়েছে বিশাল মাদক ব্যবসায়ী, কালোবাজারী, খুনি কাউকে ধরা হচ্ছে।
পরীমনির গ্রেফতারের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে কিংবা আমরা সাধারণ মানুষেরা এক করে ফেলেছি রাজ,পিয়াসা,মৌ এবং হেলেনা জাহাঙ্গীর। কোন অপরাধে কে গ্রেফতার হল, বুঝতে একটু সমস্যাই হচ্ছিল বৈকি।
মামলা হবার আগেই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে পরীমনিকে। মাদক মামলা। প্রচুর মদের বোতল পাওয়া গেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছিল শুরু থেকেই মদ ছাড়াও অন্যান্য মাদক পাওয়া গেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্ট করে এই অভিযোগ জানায়নি পুলিশ কিংবা র্যাব।
রাজের বাড়িতে পর্নোগ্রাফির বিভিন্ন আলামত পাওয়া গেছে এবং সেটার সাথে বারবার পরীমনিকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছিল। রাজের সাথে কয় বছর কিভাবে, কোন দেশে কোন হোটলে ছিলেন পরীমনি তাই বারবার প্রচার হচ্ছিল।
শুধু তাই নয়, সঠিক তথ্য উপাত্ত ছাড়াই বলা হলো পরীমনির কোটি টাকার গাড়ি একজন ব্যাংকের এমডির উপহার!
অথচ পরবর্তীতে জানা গেল গাড়িটি পরীমনির নয়। সেটা একদিনের জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন কিনবেন বলে। কিন্তু কেনেননি। গাড়িটি শোরুমেই আছে।
চারিত্রিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে যখন চলছিল ব্রিফিং এবং আলোচনা, ঠিক তখনই পাওয়া যায় ডিবির উর্দ্ধতন কর্মকর্তার সাথে পরীমনির অন্তরঙ্গ ভিডিও। বদলি করা হয় উক্ত কর্মকর্তাকে।
শাস্তির প্রসঙ্গ এলে পুলিশ থেকে বলা হয় চাকরির বিধিতে এটা অন্যায় কিন্তু আইনের চোখে অপরাধ নয়। কারো সাথে কারো সম্পর্ক থাকতেই পারে।
তাহলে পরীমনি দুবাই গেলেন নাকি রাজের সাথে কয়েক বছর ছিলেন সেটা পুলিশি ইস্যু হয় কিভাবে? পরীমনি কি দুবাই থেকে সোনার বার এনেছিলেন? সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আরেকবার অভিযান হতেই পারে তার বাড়িতে।
রিহ্যাবে না নিয়ে রিমান্ড কেন?
পরীমনি প্রচুর মদ পান করতেন, একথা সত্য। কিন্তু এটা তো অপরাধ হতে পারে না। তার লাইসেন্স ছিল। যদিও পুলিশ বলছে লাইসেন্স মেয়াদউর্ত্তীন্ন।
অতিরিক্ত মদের আসক্তি থাকলে অভিনয় করতেন কিভাবে? কোন প্রযোজক পরিচালক কি অভিযোগ করেছিলেন যে মদ খেয়ে পরী তাদের শুটিং ঠিকমতো করতেন না? বরং প্রত্যেকেই বলেছেন এক বারেই পরীমনির শট ওকে হতো।
আর যদি আসক্ত হয়েই থাকেন, তাকে রিমান্ডে নয় রিহ্যাবে নেয়ার কথা।
পুলিশ দাবি করে তার বাসায় একটি বার ছিল। সেই বারে কি মদ বিক্রি করতেন পরীমনি? মদ আসতো কোথা থেকে? গ্রামের বাড়িতে নানার পাঠানো নিশ্চয়ই নয়! উচ্চমহলের সহযোগিতা না থাকলে কিভাবে সম্ভব ?
যদি এই মদ বাড়িতে রাখা পরীমনির অপরাধ হয় তবে সেই অপরাধের শাস্তি তিনি পাবে। কিন্তু যাদের সাহসে আর সহযোগতিায় সব কিছুকে তিনি সম্ভব করেছিলেন, তাদের কি আইনের আওতায় আনা জরুরি নয়?
সেক্ষেত্রে কেন পুলিশের সদিচ্ছার অভাব?
পুরুষরা সব কি নিরপরাধ?
পরীমনির বাসায় যাদের যাতায়াত ছিল তারাও ফাঁসকৃত ভিডিওর পুলিশ কর্মকর্তার মতো নিরপরাধ। আইনের দৃষ্টিতে তারা অপরাধী নন। কিন্তু পরীমনি নষ্টা, চরিত্রহীনা,লোভী আরও কত কি!
বাধ্য হয়েই বলতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ!
এক্ষেত্রে কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকের ভূমিকা অত্যন্ত দু:খজনক। তাদের চটুল সংবাদ উপস্থাপনায় হয়তো বাজারে কাটতি বেড়েছে। কিন্তু সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার জায়গাটা একেবারেই শূন্য।
পরীমনির বাসায় যেসব প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল তারা পুলিশকে ফোন করেছে বিধায় ব্রিফিং করে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে তাদের কাউকে ধরা হবে না!
সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
মামলা করার জন্যই কি শাস্তি?
মদ্যপান যদি অপরাধ হয় তবে এই সমাজের অনেকেই অপরাধী। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরূদ্ধে মামলা আর প্রেস কনফারেন্সের শাস্তি নিশ্চয়ই পাচ্ছেন না পরীমনি।
হয়তো তার ভুল ছিল। মাত্রাজ্ঞানে ছিল না পরিমিতি বোধ।
ইতিপূর্বে পরীমনি ক্লাবে মদ্যপ অবস্থায় ভাংচুর করেছেন। ক্লাবে এমনটা হতেই পারে বিধায় হয়তো তাকে তখন কিছু বলা হয়নি। হঠাৎ কি এমন অপরাধে অপরাধী হলেন পরীমনি?
এই দেশে এখনও মৌখিক ভাবে তালাক হয়। এখনও গাছের সাথে বেঁধে ওঝা দিয়ে ঝাড় ফুঁকে চিকিৎসা হয়। জিন্স প্যান্ট পরা মেয়ে দেখে শিষ বাজানো জনগণের সংখ্যা কম নয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পরীমনিকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্যের ঝড় এরা তুলতেই পারে। কিন্তু দায়িত্বশীল পুলিশ, প্রশাসন ?
দেশের সার্বিক স্বার্থে জনগনের কল্যাণে দায়িত্ব পালনে যদি কোন একটি নির্দিষ্ট মহল, ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রাধান্য পায় তবেই শুরু হয় আস্থাহীনতা।
আস্থাহীনতা থেকে বাড়তে থাকে আলোচনা, সমালোচনা,প্রতিবাদ। সবগুলো ধাপ ব্যর্থ হবার পর সৃষ্টি হয় ক্ষোভ, ঘৃণা আর অশ্রদ্ধা।
(সাকিলা মতিন মৃদুলা একজন উন্নয়ন কর্মী। বিবিস বাংলা থেকে নেওয়া)