দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ শান্তির শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নারকীয় গ্রেনেড হামলা এবং গুলিবর্ষণ করে ঘাতকরা। সেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামি তারেক রহমান ও মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের রেড নোটিস বাতিলের পর রিইস্যু করছে না ইন্টারপোল।

বাংলাদেশ পুলিশের দফায় দফায় চেষ্টা ও অনুরোধের পরও সায় দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক পুলিশি এই সংস্থাটি। একই মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত চার আসামির বিরুদ্ধে বর্তমানে ইন্টারপোলে রেড নোটিস বহাল রয়েছে। তারা হলেন, মাওলানা তাজউদ্দিন, চৌধুরী আবদুল হারিছ ওরফে হারিছ চৌধুরী, বাবু রাতুল আহমেদ ও হানিফ আলহাজ মোহাম্মদ।

পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এনসিবিকে রেড নোটিস পাঠানোর চিঠি দেয় সিআইডি। পর দিন পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখা ইন্টারপোল জেনারেল সেক্রেটারিয়েট (আইপিএসজি) কে অনুরোধ করে। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল ইন্টারপোল থেকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধ রেড নোটিস ইস্যু করা হয়। ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি ইন্টারপোল আর্টিক্যাল-৩ অনুযায়ী তারেক রহমানের ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’-এ রয়েছেন উল্লেখ করে রেড নোটিস বাতিলের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানায়।

ওই বছরের ১৫ মার্চ তারেক রহমানের রেড নোটিস বাতিল করে ইন্টারপোল। একই বছরের ২৭ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মানিলল্ডারিং আইনে করা মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারির জন্য আইপিএসজিকে অনুরোধ করে এনসিবি। পরবর্তীতে ইন্টারপোল তারেক রহমানের রেড নোটিসের ডাটা মুছে ফেলার সুপারিশসহ চিঠি দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করে এনসিবি। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রেড নোটিস জারির জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হয়। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট অভিজ্ঞ ল’ ফার্মের মাধ্যমে তাগাদা পত্র দেওয়া হয়। ২০২১ সালে ল’ ফার্মের মাধ্যমে প্রস্তুত করা রিভিশন পত্র দিলেও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়নি ইন্টারপোল। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পুনরায় রেড নোটিস দিতে এনসিবি ঢাকা থেকে আইপিএসজির সঙ্গে পত্র যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। তারেক রহমান বিগত ১৩ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তাকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এ ছাড়া মানিলন্ডারিং ও দুর্নীতির মামলায় তার বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

এনসিবি আরও জানায়, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামি মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর রেড নোটিস ইস্যু করে ইন্টারপোল। ২০১৮ সালের ৪ মে ইন্টারপোল আর্টিক্যাল-৩ দোহাই দিয়ে রেড নোটিস বাতিল করে। ওই বছরই ৩১ মে রেড নোটিস বাতিলের বিষটি রিভিউ করে পত্র দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ইন্টারপোলের ১০৪তম সভায় মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের রেড নোটিস রিইস্যুর বিষয়টি আলোচনা হয়। ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর রেড নোটিস পুনঃবহাল সংক্রান্ত ব্যবস্থা সম্পর্কে পরামর্শের জন্য সিআইডিকে বলা হয়। সিআইডির অনুরোধপত্র পুনরায় ইন্টারপোলে পাঠানো হয়েছে। এনসিবির দেওয়া চিঠি ইন্টারপোল নথিভুক্ত করলেও রিইস্যু করেনি। কায়কোবাদের রেড নোটিস জারির বিষয়টি নিয়ে সার্বক্ষণিক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এনসিবি। কায়কোবাদ বর্তমানে সৌদি আরবে আত্মগোপনে আছেন বলে জানিয়েছেন এনসিবির কর্মকর্তারা।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিস জারি হওয়া ফাঁসির দন্ড প্রাপ্ত আসামি আলহাজ মাওলানা তাজউদ্দিন মিয়ার বিষয়ে এনসিবি জানায়, তার সম্ভাব্য অবস্থান পাকিস্তানে। তার অবস্থান শনাক্তের জন্য ২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রেড নোটিস ইস্যু করা হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে তার রেড নোটিসের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো হয়েছে। হারিছ চৌধুরীর বর্তমান অবস্থান লন্ডন, মালয়েশিয়া ও ভারতে। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে রেড নোটিস ইস্যু করা হয়। ২০২০ সালের ২৩ জুলাই নোটিসের মেয়াদ ৫ বছর বাড়ানো হয়েছে। এনসিবি আরও জানিয়েছে বাবু রাতুল আহমেদের সম্ভাব্য অবস্থান ইতালি অথবা দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস ইস্যু করে ইন্টারপোল। হানিফ আলহাজ মোহাম্মদের সম্ভাব্য অবস্থান থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি রেড নোটিস ইস্যু হয়। বিদেশে অবস্থান করা এই চার আসামির বিষয়ে এনসিবি কর্মকর্তারা ইন্টারপোল সদর দফতরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।

কারাবন্দি থাকা আসামিরা হলো: বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম, পুলিশের সাবেক আইজি শহুদুল হক, খোদা বক্স ও আশরাফুল হুদা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, ঢাকা সিটি করপোরেশেনের সাবেক কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম আরিফ, সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তার মুন্সী আতিকুর রহমান, আব্দুর রশীদ ও রুহুল আমিন, পাকিস্তানি নাগরিক আব্দুল মজিদ ওরফে ইউসুফ ভাট ওরফে আব্দুল মাজেদ ভাট, হরকাতুল জিহাদ ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের নেতা মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা ওরফে জিএম, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা আব্দুর রউফ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার আবু জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, উজ্জ্বল ওরফে রতন ও আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার। তারা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনায় পরদিন মতিঝিল থানায় মামলা হয়। এই মামলা নিয়ে ‘জজমিয়া’ গল্পসহ নানামুখী বিতর্কের পর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ মামলাটির তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেন। এতে আসামি ছিলেন মোট ৪৯ জন। আদালত এদের মধ্যে ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। রায়ের সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখানো হয়। মামলার অন্তত পাঁচজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান।

.(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২১আগস্ট, ২০২১)