আফগানিস্তানের আতঙ্ক ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: তালেবানের শীর্ষ কয়েকজন নেতা নতুন সরকার গঠনের জন্য আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে জড়ো হয়েছেন। সরকার গঠনের আলোচনায় অংশ নিতে দেশটির সবচেয়ে কুখ্যাত ও ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের দু’জন প্রতিনিধিও সেখানে গেছেন। গত কয়েক বছরে আফগানিস্তানে প্রাণঘাতী কিছু হামলার জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্ককে দায়ী করা হয়। হাক্কানি নেটওয়ার্কের হামলায় আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিক, সরকারি কর্মকর্তা এবং বিদেশি সৈন্যদের প্রাণহানি ঘটে।
তাদের কুখ্যাতি সত্ত্বেও গত সপ্তাহে তালেবান আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার পর নতুন শাসনব্যবস্থায় হাক্কানি নেটওয়ার্ক শক্তিশালী ক্রীড়ানক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হাক্কানি কারা?
জালালউদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বে এই গোষ্ঠী গঠন করা হয়েছিল। সোভিয়েতবিরোধী জিহাদের নায়ক হিসেবে ১৯৮০’র দশকে জালালউদ্দিন হাক্কানির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রদের মাধ্যমে মুজাহিদিনদের কাছে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহে সিআইএর মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছিলেন।
ওই সংঘাতের সময় এবং সোভিয়েতের চলে যাওয়ার পর ওসামা বিন লাদেনসহ বিদেশি জিহাদিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসা তালেবানের সঙ্গে জোট গড়েন তিনি। ২০০১ সালে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিকবাহিনীর অভিযানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন জালালউদ্দিন।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০১৮ সালে তালেবান জালালউদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর ঘোষণা দেয় এবং তার ছেলে সিরাজউদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধানের দায়িত্ব নেন। আর্থিক ও সামরিক শক্তির কল্যাণে এবং নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত হাক্কানি নেটওয়ার্ক তালেবানের অংশীদার হিসেবে থাকলেও তাদেরকে আধা-স্বায়ত্বশাসিত মনে করা হতো।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের ঘাঁটি প্রধানত আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে হলেও এই গোষ্ঠীর ঘাঁটি পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত এলাকাজুড়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তালেবানের নেতৃত্বে এই গোষ্ঠী বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। ২০১৫ সালে সিরাজউদ্দিন হাক্কানিকে উপ-নেতা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এক সময় আফগান সরকারের শাসনামলে জেল এবং মৃত্যুদণ্ডের সাজা পেলেও তার ছোট ভাই আনাস গত সপ্তাহে কাবুলের পতনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং সাবেক-প্রধান নির্বাহী আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
গত দুই দশকে আফগানিস্তানে সবচেয়ে প্রাণঘাতী এবং মর্মান্তিক বেশ কিছু হামলার জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্ককে দায়ী করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের হাক্কানি নেটওয়ার্ককে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে এবং জাতিসংঘ এই সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
প্রচুর বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি এবং ট্রাকে করে বারবার আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ব্যবহারের জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্কের কুখ্যাতি রয়েছে। বিভিন্ন সময় সামরিক স্থাপনা এবং দূতাবাসসহ অধিক সুরক্ষিত ও নিরাপত্তাবেষ্টিত প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে অত্যন্ত জটিল, ব্যাপক প্রাণঘাতী হামলা চালানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে এই নেটওয়ার্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী দেশটির পূর্বাঞ্চলে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রায় ২৮ টন বিস্ফোরক বোঝাই একটি ট্রাক জব্দ করে। ২০০৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করে এই নেটওয়ার্ক। এছাড়া দেশটিতে বেশ কিছু গুপ্তহত্যা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও পশ্চিমা নাগরিকদের অপহরণ করে হাক্কানি নেটওয়ার্ক। এমনকি অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় ও বন্দি বিনিময়েও বাধ্য করতো এই গোষ্ঠী।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও হাক্কানি নেটওয়ার্কের সম্পর্ক নিয়েও সন্দেহপোষণ করেন কেউ কেউ। ২০১১ সালে মার্কিন অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন হাক্কানি নেটওয়ার্ককে ইসলামাবাদের গোয়েন্দাদের ‘সত্যিকারের অস্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
গত জুনে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা এক প্রতিবেদনে বলেছেন, তালেবানদের লড়াইয়ে ব্যাপক অবদান রেখেছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং তারাই এই গোষ্ঠীর ‘যুদ্ধের জন্য সর্বাধিক প্রস্তুত বাহিনী’। তালেবান এবং আল-কায়েদার সঙ্গে এই নেটওয়ার্কের সম্পর্ক আছে বলেও তারা জানান।
তালেবানের নতুন শাসনে হাক্কানি নেটওয়ার্কের ভূমিকা কী?
আফগানিস্তানে নতুন সরকার গঠনের আলোচনা শুরু হওয়ায় তালেবানের রাজনৈতিক প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়ানক হিসেবে হাজির হয়েছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক। ইতোমধ্যে দেশটির রাজধানী কাবুলে এই নেটওয়ার্কের দু’জন নেতা তালেবানের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ছয় বছর আগে সিরাজউদ্দিন হাক্কানির উপনেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিক পদোন্নতি তালেবানের বর্তমান সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় তাকে অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে হাজির করেছে। ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের কারাগার থেকে তার ভাই আনাসের মুক্তি যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানের সরাসরি আলোচনার সূচনা করার জন্য একটি পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হয়; যা শেষ পর্যন্ত মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের দিকে এগিয়ে যায়।
গত বছর নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে সিরাজউদ্দিন হাক্কানি আফগানিস্তানে মার্কিন আলোচনায় তালেবানদের অবস্থান এবং সংঘাতের রূপরেখা তুলে ধরেন। কূটনীতির সুরে তিনি এই নিবন্ধ লিখলেও নেটওয়ার্কের সহিংস কুখ্যাতি অস্বীকারের উপায় নেই।
আনাস হাক্কানি যখন কারজাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন, তখন তার চাচা খলিল হাক্কানিকে শুক্রবার কাবুলে জুমার নামাজে ইমামতি করতে দেখা যায়। সিরাজউদ্দিন এবং খলিল উভয়ে এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের তালিকায় আছে। যাদের মাথার দাম কয়েক কোটি ডলার ঘোষণা করা হয়।
.(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২২আগস্ট, ২০২১)