প্যান্ডোরা পেপারস ও অফশোর কোম্পানির সাতকাহন
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: এক খবরেই বিশ্ব তোলপাড়। দেশে দেশে ঘুম হারাম নেতাদের। একদিন আগেও যাদের দাপটে ঠকঠক করে কাঁপত পুরো রাজতখত, সেই নেতাদেরই পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দিয়েছে এই ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) বরাবরের মতোই একটি দুঃসাহসী প্রয়াস। এবার এর নাম দিয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’ বা ‘প্যান্ডোরা বক্স’। ১৪০টির বেশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করা এ সংগঠনের এটি সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক অনুসন্ধান। যুক্তরাজ্যে অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিয়েছে বিবিসি প্যানোরামা ও গার্ডিয়ান, ভারতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
রোববার প্রকাশিত এ প্যান্ডোরা পেপারস ফাঁসের ঘটনায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নথি উন্মোচিত হয়েছে। সামনে চলে এসেছে বিশ্বের অনেক ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও গুপ্ত সম্পদের তথ্য। ১৪টি উৎস থেকে ১১৭টি দেশের ৬০০-এর বেশি সাংবাদিক কয়েক মাস ধরে নথিগুলো সংগ্রহ করেছেন। গোপন সেই নথিগুলো এ সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়েছে। এসব নথিতে দেখা গেছে-৯০টি দেশের ৩৩০ জনেরও বেশি রাজনীতিবিদ তাদের সম্পদের তথ্য গোপন রাখতে অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করেছেন।
কী এই প্যান্ডোরা : প্যান্ডোরা শব্দের আভিধানিক অর্থ শামুক শ্রেণির এক ধরনের প্রাণী, যার খোলস অনেকটাই ভঙ্গুর। যে কারণে হালকা চাপেই তা ভেঙে যেতে পারে ও ভেতরের জিনিস বের হয়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে মিলিয়েই মূলত এবারের গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনাটির নাম দেওয়া হয়েছে প্যান্ডোরা বক্স। এই বক্সের ঢাকনা খুলতেই একে একে বেরিয়ে আসছে বিশ্বনেতাদের গোপন আর্থিক লেনদেনের তথ্য। এরই মধ্যে এই বক্স থেকে বেরিয়েছে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের দুর্নীতির খবর।
সাত বছরে প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস ইত্যাদি নামে যেসব গোপন দলিলপত্র ফাঁস হয়েছে, এই প্যান্ডোরা পেপারস হচ্ছে তার সবশেষ ঘটনা। পানামা পেপারসসহ বিভিন্ন আর্থিক নথি ফাঁস হওয়ার পর কর ফাঁকি কিংবা সম্পদ গোপনের মতো কাজগুলো কঠিন করে তোলার দাবি ওঠে। এর জন্য ব্যবস্থা নিতে বারবারই রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্যান্ডোরা পেপারস কী উন্মোচন করেছে : প্যান্ডোরা পেপারসের মধ্য দিয়ে ৬৪ লাখ নথি, ৩০ লাখ ছবি, ১০ লাখের বেশি ই-মেইল ও প্রায় ৫ লাখ হিসাবের নথি উন্মোচিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এর আওতায় যেসব গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মালিকানা গোপন করে কোম্পানি স্থাপন করেছেন জর্ডানের বাদশাহ। সেখানে সাত কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেছেন তিনি। আজারবাইজানের শীর্ষস্থানীয় পরিবারের যুক্তরাজ্যে লুকানো সম্পদের পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের বেশি। ১ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড ব্যয়ে ফ্রান্সে দুটি বাড়ি কিনতে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর অফশোর বিনিয়োগ কোম্পানি খোলার কথা গোপন রাখা। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তার পরিবার কীভাবে দশকের পর দশক ধরে গোপনে অফশোর কোম্পানিগুলোর মালিকানা ধরে রেখেছে।
অফশোর কোম্পানি কী : অফশোর কোম্পানি হলো কাগজে-কলমে নামমাত্র কোম্পানি। এর কোনো কার্যালয় কিংবা কর্মী থাকে না। তবে এর পেছনে অর্থ খরচ হয়। যিনি কোম্পানির মালিক, তার পক্ষ থেকে কোম্পানি গঠন ও পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ ফার্মগুলোকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এসব ফার্ম প্রতিষ্ঠানটির একটি ঠিকানা ঠিক করে দিতে পারে ও বেতনভুক্ত পরিচালকদের নাম জানাতে পারে। তবে সত্যিকার অর্থে ওই ব্যবসার নেপথ্যে কে আছে, তা জানার সুযোগ থাকে না। এসব কোম্পানির প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ। বিভিন্ন আইনি জটিলতার কারণে এসব কোম্পানির মালিকদের শনাক্ত করা কঠিন।
করস্বর্গের ব্যবহার কি অবৈধ : বিভিন্ন দেশে আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে বৈধভাবে কিছু কর ফাঁকি দিতে পারে মানুষ। করস্বর্গ বলে পরিচিত দেশগুলোয় টাকা সরিয়ে নিয়ে কিংবা সেখানে কোম্পানি স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ সুযোগ কাজে লাগায় তারা। তবে প্রায়ই একে অনৈতিক বলে বিবেচনা করা হয়। ভিনদেশে অর্থ ও সম্পদ রাখতে চাওয়ার পেছনে কিছু বৈধ কারণও রয়েছে। এসব কারণের মধ্যে আছে অপরাধীদের আক্রমণ কিংবা অস্থিতিশীল সরকার থেকে সুরক্ষা। গোপনে অফশোর কোম্পানির মালিকানা থাকা অবৈধ কিছু না হলেও অর্থ ও সম্পদ সরিয়ে নেওয়ার কাজে এ ধরনের গোপন কোম্পানির ব্যবহার ভালো কিছু নয়; বরং তা অপরাধের প্রক্রিয়া গোপন রাখার একটি যথাযথ উপায়।
অফশোরে কী পরিমাণ অর্থ লুকানো থাকে : এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন যে, অফশোর কোম্পানিগুলোয় ঠিক কী পরিমাণ অর্থ লুকানো আছে। তবে আইসিআইজের তথ্য অনুযায়ী, এর পরিমাণ ৫ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন (১০০ বিলিয়নে ১ ট্রিলিয়ন) থেকে ৩২ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, করস্বর্গের দেশ বা কোম্পানিতে ক্ষমতাবানদের বিনিয়োগের কারণে বিশ্বের দেশগুলো বছরে ৬০০ বিলিয়ন (১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন) ডলার ক্ষতি গুনছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির গবেষক লক্ষ্মী কুমার মনে করেন, এ ধরনের প্রবণতার কারণে সমাজের বাকি অংশের ওপরও প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, ‘অর্থ গোপন রাখার সক্ষমতা থাকার মানে হলো আপনার জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব পড়া।’
কীভাবে এসেছে এত তথ্য : ১১.৯ মিলিয়নের বেশি রেকর্ডগুলো মূলত অসংগঠিত ছিল। ফাইলের অর্ধেকেরও বেশি (৬.৪ মিলিয়ন) ছিল টেক্সট ডকুমেন্ট, যেখানে পিডিএফ ডকুমেন্ট চার মিলিয়নের বেশি, এগুলোতে ১০,০০০ পৃষ্ঠারও বেশি চলে গেছে। নথির মধ্যে ছিল পাসপোর্ট, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ট্যাক্স ডিক্লারেশন, কোম্পানির অন্তর্ভুক্তির রেকর্ড, রিয়েল এস্টেট চুক্তি ও যথাযথ অধ্যবসায়ের প্রশ্নপত্র। ফাঁস হওয়া ডেটার মধ্যে ৪.১ মিলিয়নেরও বেশি ছবি ও ই-মেইল ছিল। ডকুমেন্টের ৪ শতাংশ হিসাবের নথি। রেকর্ডগুলোতে স্লাইড শো ও অডিও এবং ভিডিও ফাইলও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০৬ অক্টোবর, ২০২১)