মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের পদত্যাগ : রাজনীতিতে নতুন সঙ্কট
দিরিপোর্ট২৪ প্রতিবেদক : ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা সোমবার মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাদের এই পদত্যাগ রাজনীতিতে নতুন সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর পদের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন, সদস্যদের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর আর পদে থাকার বৈধতা থাকে না। কেউ বলছেন, পদত্যাগের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পুনর্গঠন আইনের লঙ্ঘন। আবার অনেকে বলছেন, এই ঘটনায় প্রমাণ হয় যে সরকারের মধ্যে সমন্বয় নেই।
এদিকে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলেও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঞা বলছেন, নতুন মন্ত্রিপরিষদ পুনর্গঠন সম্পর্কে নির্দেশনা তার কাছে নেই।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি বলেন, ‘সংবিধানের ৫৮ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি কোনো মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ পদত্যাগপত্র দেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব পালন করলে তা সংবিধান অনুযায়ী অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে বলেও জানান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমীন বেপারি দিরিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, ‘অবশেষে আজকে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন বলে টেলিভিশনের সংবাদে দেখলাম। সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করলে উনাদের আর মন্ত্রী থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু আবার দেখলাম মন্ত্রী পরিষদ সচিব বললেন, মন্ত্রীরা পদত্যাগ করছেন না মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সরকারের মধ্যেই সমন্বয় নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আসলে সংবিধানে সর্বদলীয় সরকার বলতে কিছু নেই। এটি সরকার সৃষ্ট নতুন ধারণা। নতুন করে সরকার মন্ত্রিসভা গঠন করলে তা সংবিধান সম্মত হবে না। বরং তা হবে সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম দিরিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, ‘বর্তমান সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীটাই একটা গোঁজামিল। যারা সংবিধান বোঝেন তাদের কাছে এটা স্পষ্ট, মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলে তারা আর মন্ত্রী থাকেন না। আর মন্ত্রিসভা-ই যদি না থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রীও তো থাকেন না। আমরা এখন সাংবিধানিক শূন্যতার মধ্যে রয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন যে কথা বললেন, তাতে আমরা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গিয়েছি। উনি বললেন, মন্ত্রিরা পদত্যাগ করেননি। অথচ আমরা শুনলাম, দেখলাম মন্ত্রীরাই বললেন তারা পদত্যাগ করেছেন। তাহলে আমরা কি বলবো?’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘একেক দিন একেক জন একেক কথা বলছেন। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নির্বাচনে যাবে কি না সেটা পরিস্কার করে কেউ বলছে না। মন্ত্রীদের ভূমিকা কী হবে সে বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। ইসি কী ভূমিকা নিবে তাও তারা পরিষ্কার করছে না।’
মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন প্রতিমন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিরিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, ‘পদত্যাগপত্রে কোন তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। পদত্যাগের বিষয়ে যেদিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আদেশ জারি করা হবে সেদিন পর্যন্ত বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা কাজ চালিয়ে যাবেন।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ম-লীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘সংসদীয় রীতিতে নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠান। প্রধানমন্ত্রী সেগুলো রাষ্ট্রপতি বরাবর উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে আহ্বান জানান। আজকে মন্ত্রীদের পদত্যাগ সেই নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে। তাই আমি মনে করি এতে সাংবিধানিক কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু দিরিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের পদত্যাগপত্র সংবিধান অনুযায়ীই দিয়েছি। তাই এতে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার কাঠামোর মধ্যে সোমবারই হয়তো সর্বশেষ মন্ত্রিসভা বৈঠক হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঞা। তার আগে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাজ করার বৈধতা থাকে না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমি সংবিধানের ব্যাখ্যা দিতে বসিনি। পদত্যাগপত্রগুলো এখনো আমি দেখিনি, আপনিও দেখেননি। প্রকৃতপক্ষে সেখানে কি লেখা আছে তা জানতে হবে। আমি প্রজ্ঞাপন জারি করা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেব।
তিনি আরো বলেন, আমি আমার পদত্যাগপত্র দিতেই পারি। এছাড়া এটা মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া নয়। এটা পুনর্গঠন।
পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার এ টার্মগুলো নেই। মন্ত্রিসভার কথা বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা আছে। পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা-ই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কতদিন পর পর বসবেন। কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন।
(দিরিপোর্ট২৪/টিম/এইচএসএম/নভেম্বর ১১, ২০১৩)