ডুবে যাওয়া ফেরিটি ছিলো ফিটনেসবিহীন
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে চলাচলকারী আমানত শাহ ফেরিটি ৪২ বছরের পুরোনো। চলছিলো জোড়াতালি দিয়ে। এ ক্ষেত্রে পদে পদে ছিল উদাসীনতা আর অবহেলা। কয়েক মাস মেরামত করা হলেও সম্প্রতি এর তলদেশে ছিদ্র হয়। এ অবস্থায় মেরামত ছাড়াই বহু গাড়ি নিয়ে বহু মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে গতকাল বুধবারও সেটি যাত্রা করেছিল। সকালে পাটুরিয়া ফেরিঘাটে নোঙর করার পর ১৭টি ট্রাক ও বেশকিছু মোটরসাইকেল নিয়ে ডুবে যায় এটি।
ফেরির তলদেশে ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে কারো মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। ঘাটে নোঙর করার পর সেটি ডুবে গেছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছিল চার দশকের বেশি সময়ের পুরোনো ফিটনেসবিহীন ফেরিটি। দুর্ঘটনা পদ্মার মাঝে ঘটলে অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারত। ফেরিতে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিলেন। তারা আগেই নেমে যেতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশে নিয়মিত নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলেও কখনো ফেরিডুবির ঘটনা ঘটেনি বলে জানায় বিআইডব্লিউটিসি। এ দুর্ঘটনায় ফেরি ব্যবহারকারী যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত ফেরিটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ডুবে যাওয়া অন্তত ৯টি ট্রাক ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা।
দুর্ঘটনায় ১৫ জন আহত হয়েছেন। তারা স্থানীয় ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, সকাল পৌনে ১০টার দিকে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে যানবাহন লোড করে পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে নোঙর করে আনলোড হচ্ছিল রো রো ফেরি আমানত শাহ। এ সময় ফেরিতে থাকা ট্রাকগুলো পদ্মায় ডুবে যায়। দেশে ফেরিডুবির ঘটনা এটাই প্রথম। বিআইডব্লিউটিসির এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানান, ৪২ বছর আগের ফেরি আমানত শাহ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল ফিটনেসবিহীনভাবে।
সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি ইউনিট কাজ করে। হামজাও কাজ শুরু করেছে। তবে হামজার উদ্ধার ক্ষমতা ৬০ টন, আর ফেরিটির ওজন এক হাজার টনের কাছাকাছি। ফলে উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা।
উদ্ধার কাজে মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রত্যয় নামে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ রওনা দিয়েছে। এটির উদ্ধারের সক্ষমতা ২৫০ টন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলাম জানান, তাদের দুটি টিম উদ্ধার কাজ করছে। ঢাকা থেকে ৩টি টিমসহ মোট ৫টি টিম কাজ করছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম, পরিচালক (বাণিজ্য) আশিকুজ্জামান, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান, বিআইডব্লিউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সহসভাপতি মহসিন ভুঁইয়া প্রমুখ।
জানা গেছে, ফেরিটি ১৯৭৯ সালে আরিচা ফেরি সেক্টরে যোগ দেয়। ফেরির মাস্টার শরিফুল ইসলাম লিটন জানান- চার মাস আগে ফেরিটি নারায়ণগঞ্জ থেকে ভারী মেরামত শেষে পাটুরিয়া সার্ভিসে আসে। তবে সম্প্রতি ফেরিটির তলদেশে একটি ছিদ্র হয়। দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া গিয়ে ভাসমান কারখানা মধুমতিতে তা মেরামত করার কথা ছিল। ফেরিটি দৌলতদিয়া ঘাট থেকে পাটুরিয়া অভিমুখে রওনা দেওয়ার কিছু সময় পরই তলদেশের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করে। ভালোভাবেই তিনি ফেরিটি পাটুরিয়া ঘাটে নোঙর করেন। এর পর যানবাহন আনলোড শুরু হওয়ার পরপরই ফেরিটি কাত হয়ে ডুবে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা: ফেরিতে থাকা কেমিক্যাল বহনকারী আফজাল পার্সেলের কাভার্ডভ্যানের চালক সেলিম হোসেন জানান, তার গাড়িটি আনলোড হওয়ার শেষ মুহূর্তে ফেরিটি ডুবে যায়। তিনি জানান, তার গাড়ির দুই চাকা ছিল পন্টুনে, আর দুই চাকা ছিল ফেরির ভেতরে। ট্রাকচালক বছির উদ্দিন জানান, তার ট্রাক ছিল সবার পেছনে। তিনি গাড়ি চালু করার পরপরই ফেরিটি ডানদিকে কাত হয়ে হেলে পড়ে। এর পর সবার মতো তিনিও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করেন।
কুষ্টিয়া থেকে আসা এ ফেরির মোটরসাইকেল যাত্রী মোহাম্মদ সুজন জানান, দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে আসার পর মাঝ পদ্মাতেই ফেরিতে পানি ঢুকতে শুরু করে এবং ফেরি কিছুটা কাত হয়ে যায়। ফেরিটি ৫ নম্বর ঘাটে আসামাত্রই তলিয়ে যেতে থাকে। এ সময় একটা গাড়ির আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা লাগছিল। ভয়ে তিনি মোটরসাইকেল রেখেই নদীতে ঝাঁপ দেন।
তদন্ত টিম গঠন: সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সুলতান আব্দুল হামিদকে প্রধান করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, ফেরিডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সানোয়ারুল হককে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হযেছে। ৫ কার্যদিবসে তদন্ত প্রতিবেদন জমাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, পদ্মা নদীসহ দেশের বিভিন্ন নৌপথে চলাচলকারী ৫৩টি ফেরির মধ্যে বেশিরভাগেরই ফিটনেস নেই। ৫০-৬০ বছরের পুরোনো ফেরিগুলোর মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবু এগুলো জোড়াতালি দিয়ে ঝুঁকিসহ চালানো হচ্ছে।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ২৮ অক্টোবর, ২০২১)