দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ড্যান্স কামরুল (৩৭)। ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে আসেন ঢাকায়। রাজধানীতে এসেই শুরু করেন রিকশা চালানো। এরপর কৌতূহলবশত ২০১৬ সালে এফডিসি ও বিভিন্ন শুটিং স্পটে আসা-যাওয়া শুরু তার।

এরপর প্রতিষ্ঠা করেন কথিত ‘ড্যান্স ক্লাব’। সেখানে তরুণীদের নাচ বা গান শেখানোর আড়ালে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন। তার ক্লাবের মাধ্যমে অনেককে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচারও করা হয়। এরই মধ্যে দুজন নারী দেশটির কারাগারে রয়েছেন। কামরুল ড্যান্স ক্লাব বা সেলুনে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছেন।

শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে শনিবার (৩০ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও ও চুয়াডাঙ্গা থেকে বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারী ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়। এসময় পৃথক নারী পাচারচক্রের প্রধান অভিযুক্তসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

শনিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে মিরপুর র‌্যাব-৪ কার্যালয়ে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেফতাররা হলেন- ভারতে পাচারচক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল বা ড্যান্স কামরুল, রিপন মোল্লা, আসাদুজ্জামান সেলিম, নাইমুর রহমান। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারচক্রের বাকি সদস্যরা হলেন- নুর নবী ভুইয়া রানা, আবুল বাশার, আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহিদ শিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও টোকন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল বা ড্যান্স কামরুল। এই চক্রে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার অপরাধে জড়িত। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কম বয়সী তরুণীদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে ও প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেন।

প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ বা ড্যান্স শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। পরে তাদের বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা হতো। পরে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকরিতে প্রলুব্ধ করে পাচার করতো চক্রটি। এভাবে চক্রটি তিন বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে।

তিনি আরও বলেন, ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশের মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশে অমানবিক ও অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করতো। এই চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।

তারা ভিকটিমদের সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে জানিয়ে কমান্ডার মঈন জানান, এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। এরপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহর বা প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিতো। এরপর থেকে ভিকটিমদের আর কোনো সন্ধান মিলতো না।

কে এই কামরুল ইসলাম ওরফে ডিজে কামরুল?
২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। এরপর বাড্ডা এলাকায় রিকশাচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কয়েকদিন পর তিনি একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যানচালক হিসেবে কাজ নেন। এরপর ড্যান্স গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবের মাধ্যমে উঠতি বয়সী নারীদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করতেন তিনি। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতেন।

র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এছাড়া একজন ‘মা’ নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে মেয়েকে পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন, যে ঘটনা ভাইরাল হয়।

র‌্যাব আরও জানায়, কামরুলের মাধ্যমে এক নারীকে ভারতে পাচারের ঘটনায় তার বোন বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। সেই মামলায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশ তাকে আটক করে। তিনমাস পর কারাগার থেকে বের হয়ে পুনরায় নারী পাচারে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এসব নারীদের সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেফ হাউজে রাখা হতো। পরে সেফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের মোবাইল নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতো। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রের সদস্যরা নারীদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতো। এই চক্রের গ্রেফতার রিপন, সেলিম ও শামীম নারী পাচারের অবৈধ কাজে মূলহোতাকে সহায়তা করতো বলে স্বীকার করেছে।

এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে পাচার চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী একটি চক্র। চক্রে দেশের ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ৫ থেকে ৭ বছর ধরে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার করে আসছে। হাউজ কিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি পেশায় নারী কর্মীদের বিনা টাকায় পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সী তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের প্রলুব্ধ করতো চক্রটি। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেওয়া হতো।

চক্রটি এরই মধ্যে ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে বলে জানতে পেরেছি। পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেফ হাউজ পরিচালনা করে। বেশ কয়েকদিন সেফ হাউজে ভিকটিমদের আটকে রেখে পরে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ভিকটিমদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হতো। চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয়। চক্রটি কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে আসছে।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রথমত তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উঠতি বয়সী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে ও বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখায়। এতে তারা রাজী হলে প্রথমত তাদের ঢাকায় অবস্থিত সাজানো অফিসে এনে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানো হয়। বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বল্পকালীন ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তারা। এ সময় কোনো নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের থেকে দেড়-দুই লাখ টাকা দাবি করতো চক্রটি। এই মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা নুর-নবী ভুইয়া রানা।

কে এই নুর-নবী ভুইয়া রানা?
চক্রের প্রধান নুর-নবী ভুইয়া রানা লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় একটি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে। পরে ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করেন। ওমানে থাকা অবস্থায় পাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন থেকেই মানবপাচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/৩০ অক্টোবর, ২০২১)