দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির দায়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি তাকে মেয়র পদ থেকে সরানোর দাবিও উঠেছে। শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এই নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। গণভবনে বিকাল ৪টায় শুরু হয়ে এ সভা চলে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত।

সভায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদতদাতা ও বিদ্রোহীদের তালিকা করতে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা এ তথ্য জানিয়ে বলেন, দলীয় সভাপতি জানিয়ে দিয়েছেন অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাংগঠনিক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

এদিকে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে জয় লাভ করে মেয়র হওয়ায় তিনি এখন এই পদে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে বিদ্যমান আইনে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় বিষয়টিকে নতুন অভিজ্ঞতা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের মেয়র পদ থাকবে কি না আইন পর্যালোচনা করে তার পরেই বলা যাবে। তবে সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার বলছেন, তার আর মেয়র পদে থাকার বৈধতা নেই।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জাহাঙ্গীরের বিষয়টি উত্থাপন করলে শুরুতেই বক্তব্য রাখেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরকে কী ভাষায় শোকজ দেওয়া হয়েছে এবং উত্তর কী এসেছে আমরা জানতে চাই।

পরে ওবায়দুল কাদের তা পড়ে শোনান। এরপর নাছিম বলেন, ‘জাহাঙ্গীর অমার্জনীয় অপরাধ করেছে। এই কুলাঙ্গারের আওয়ামী লীগ করার অধিকার নেই।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘জাহাঙ্গীর তার অপরাধের কথা স্বীকার করেনি। তার বক্তব্য জাতির অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ। তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।’

অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আমাদের অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে। এখানে বিএনপি-জামাতও আঘাত করার সাহস দেখায়নি। তার আওয়ামী লীগে থাকার অধিকার নেই।’ জাহাঙ্গীরের সর্বোচ্চ শাস্তি চান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনিও।

বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের মহান স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করতে বিএনপি-জামাত যে সুরে কথা বলে জাহাঙ্গীরও সেই সুরে কথা বলেছে। তার শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।’

দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘তাকে শুধু দল থেকে বহিষ্কার নয়, মামলা করতে হব, মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করতে হবে।’

স্বাস্থ্য সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা বলেন, ‘এই অবমামনানা কোনোভাবেই সহ্য করার মতো নয়।’

বৈঠকের প্রায় ৩৫ জন নেতাই জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, ‘ভবিষ্যতে এমন ধৃষ্টতা যাতে কেউ দেখাতে না পারে—জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।’ এ সময় তাকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে কীভাবে তাকে অব্যাহতি দেওয়া যায় সে ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন নেতাদের।

এদিকে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দল থেকে বহিষ্কার হলে মেয়র পদে থাকতে পারবেন না বলে মনে করেন একজন আইন গবেষক। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, দল থেকে পদ হারালে মনোনয়নপত্রের প্রতীকও হারাবে। সেক্ষেত্রে পদে থাকার কথা নয়।

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট করতে ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করা হয়। তখন শুধু দলীয় প্রতীক ও প্রার্থিতার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। মেয়র পদ থেকে অপসারণের বিষয়ে নিয়মের কোনো পরিবর্তন হয়নি। করপোরেশন আইনেও এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে ‘মেয়র ও কাউন্সিলরগণের সাময়িক বরখাস্তকরণ’ অংশে বলা হয়েছে- ১২ (১) সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে ক্ষেত্রমতো মেয়র বা কোনো কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে।

১২ (২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হলে সেই আদেশপ্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্ত মেয়র, ক্রমানুসারে মেয়র প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। মেয়রের বিরুদ্ধে আনা আইনি কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত, অথবা সেই মেয়র অপসারিত হলে, তার পরিবর্তে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

মেয়র এবং কাউন্সিলরদের অপসারণের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে-

১৩ (১) মেয়র অথবা কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন, যদি তিনি-

(ক) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; অথবা

(খ) নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন;

(গ) দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন;

(ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন;

(ঙ) নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হয়;

(চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার পরিবর্তে ন্যূনতম ৯টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুষ্ঠান করতে, বা ক্ষেত্রমতো, সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হন।

এখানে ‘অসদাচরণ’ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, এ আইন অনুযায়ী বিধি-নিষেধ পরিপন্থী কার্যকলাপ, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য দেওয়াকে বোঝাবে।

আইনে আরও বলা আছে, অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিধি অনুযায়ী তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরকে পদ থেকে অপসারণ করা হলে, ওই আদেশের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করতে পারবেন এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপসারণের আদেশ স্থগিত থাকবে। সব পক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ওই অপসারণের আদেশ পরিবর্তন, বাতিল বা বহাল রাখতে পারবেন। আপিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

অপসারিত কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্যকালের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন না। তবে দল থেকে বহিষ্কার হলে কী করা হবে সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২০ নভেম্বর, ২০২১)