প্রশ্নফাঁস: ছাপার পর ২ সেট প্রশ্ন নিতেন বুয়েট শিক্ষক!
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তার নাম আসার পর সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্রে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন শিক্ষকের নাম এলো। তিনি নিখিল রঞ্জন ধর। বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এই ব্যক্তি। আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (এইউএসটি) নিয়োগ পরীক্ষার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষাসহ প্রতিবার চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার পর তিনি দুই সেট সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘একজন আসামি আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বুয়েটের একজন শিক্ষকের নাম বলেছেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। তিনি কীভাবে প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তার কী ভূমিকা ছিল, সব খতিয়ে দেখা হবে। তাকে প্রয়োজনে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুরো বিষয়টি তদন্তের পর পরিষ্কার বোঝা যাবে।’
গত ৬ নভেম্বর থকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রথমে চাকরির প্রশ্নফাঁস চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। গ্রেফতার হয়েছেন মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহামান মিলন এবং রাইসুল ইসলাম স্বপন। এর পরদিন গ্রেফতার করা হয় সোহেল রানা, এমদাদুল হক খোকন ও এবিএম জাহিদকে। তাদের মধ্যে পাঁচ জনই বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা।
সবশেষ ১৭ নভেম্বর রাতে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় এই চক্রের অন্যতম হোতা দেলোয়ার, পারভেজ ও রবিউলকে। তারা তিন জনই আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী। গ্রেফতারের পরদিন সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা আক্তারের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দেলোয়ার জানিয়েছেন, তিনি প্রশ্ন তৈরি থেকে শুরু করে ছাপা হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের কাজে যুক্ত থাকতেন। সহকর্মী ও অন্যদের প্ররোচনায় অর্থের লোভে প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ারের দাবি, প্রতিবার প্রশ্ন ছাপা হওয়ার পর তিনি দুই সেট করে প্রশ্ন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের ব্যাগে তুলে দিতেন। নিখিল রঞ্জন ধর দুই সেট প্রশ্নপত্র নেওয়া প্রসঙ্গে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করতেন। কাউকে জানালে চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকিও দিতেন।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রশ্ন অনুমোদন পাওয়ার পর ছাপা হওয়া প্রথম কপি আমি নিজের ব্যাগে রাখতাম সত্যি, তবে সেই কাগজ পরে ফেলে দিতাম। কখনও ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র বাসায় নিয়ে আসিনি।’
বুয়েটের এই শিক্ষক জানান, তিনি আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মৌখিক ভিত্তিতে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষা নেওয়ার কাজে কারিগরি সহায়তা দিতেন। এজন্যই তিনি প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার সময় আশুলিয়ায় আহ্ছানউল্লার ছাপাখানায় যেতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৪ সাল থেকে চাকরির পরীক্ষা নেওয়ার দরপত্রে অংশ নেওয়া শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে তারা অনেক নিয়োগ পরীক্ষার কাজ করেছে। শুরু থেকেই এতে সম্পৃক্ত ছিলেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তবে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কার্যক্রমে তার যুক্ত হওয়া এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান দেওয়ার বিষয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষের কোনও অনুমতি ছিল না। এইউএসটি’র ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী শরিফুল আলমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি কাজ করতেন। অধ্যাপক ড. শরিফুল আলমের অফিস পিয়ন হিসেবেই কাজ করতেন প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা দেলোয়ার।
অধ্যাপক ড. শরীফুল আলম বলেন, ‘নিখিল রঞ্জন ধরের মাধ্যমেই আমরা পরীক্ষার কাজগুলো পেয়েছিলাম। তিনি আমাদের হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তিনি মৌখিক চুক্তিতে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করতেন। কোনও লিখিত চুক্তি বা কিছু ছিল না।’
প্রশ্নফাঁস হওয়া প্রসঙ্গে এই অধ্যাপকের দাবি, ‘এগুলো আমার জানা নেই। আগে এরকমটা হলে তো অভিযোগ উঠতো।’
এর আগে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম-পরিচালক আলমাস আলী নামের একজন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়। তিনি নিজে এই চক্রকে পরীক্ষার্থী জোগান দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন। অবশ্য কয়েক মাস আগে আরেকটি নিয়োগ পরীক্ষায় তদবির করায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। নতুনভাবে ওঠা অভিযোগের বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ছাপা হওয়ার পর প্রেস থেকে দুই সেট প্রশ্ন নিয়ে আসা বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের একটি ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। নিখিল রঞ্জন ও তার স্ত্রী অনুরূপা ধরের সোনালী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে গত সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে নিয়োগ পরীক্ষার আশেপাশের সময়গুলোতে তার ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। সাত বছর ধরেই তিনি আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর প্রথমে এত টাকা নেই বলে কাছে দাবি করেন। তবে তার সামনে ব্যাংক স্টেটমেন্ট তুলে ধরা হলে তিনি সুর পাল্টে জানান, বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে গিয়ে তিনি এসব অর্থ উপার্জন করেছেন। এছাড়া এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া সংক্রান্তে খুব সামান্য অর্থ পান বলে দাবি তার। তবে আর্থিক বিষয়টি ওঠার পর তিনি খাতা দেখা এবং প্রশ্নপত্র তৈরি ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে এসব অর্থ আয় করেছেন বলে দাবি করেন।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২০ নভেম্বর, ২০২১)