বাহাই ধর্মের প্রাথমিক দর্শন
দিরিপোর্ট২৪ ডেস্ক : বাহাই ধর্ম হচ্ছে পারস্যের মির্যা হুসাইন আলী আন নূরী আল মাযিন্দারানী ওরফে বাহাউল্লাহ (নভেম্বর ১২, ১৮১৭ - মে ২৯, ১৮৯২) প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী ধর্ম বা বিশ্বাস। তিনি নিজেকে বাবী খলিফা বলে ঘোষণা করেন। মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি। বিশ্বের দুইশয়ের বেশি দেশে এই ধর্মের প্রায় ৬০ লাখ অনুসারী রয়েছে।
‘বাবী’ শব্দটি আরবী ‘বাব’ থেকে এসেছে। এর অর্থ দরজা ও ফটক। মির্যা হুসাইন নিজেকে বাব তথা নিরাপদ ও আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করার মূল ফটক হিসেবে তুলে ধরতে এ শব্দটি নিজের জন্য ব্যবহার করেন। এরপর তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘বাহাউল্লাহ’ নাম ধারণ করে। ‘বাহাউল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর গৌরব, মহিমা বা উজ্জ্বলদীপ্ত। তার অনুসারীরা কখনো বাবী, কখনো বাহায়ী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত।
তিনি কিছু অনুসারীকে ভারতে যাবার জন্য উৎসাহিত করেন। ধারণা করা হয় তাদের মধ্যে জামাল এফেন্দি হচ্ছেন প্রথম যিনি একাধিকবার ঢাকায় এসেছিলেন। বার্মায় থাকাকালীন সময়ে বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত চট্টগ্রামের একটি গোষ্ঠী বাহাই ধর্ম গ্রহণ করে। ১৯৫০ সালের দিকে তারা চট্টগ্রাম ও ঢাকায় লোকাল স্পিরিচুয়াল এসেম্বলি গঠন করে। ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়ার জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে বাহাই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১০,০০০। ঢাকার শান্তিনগরে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের পাশে রয়েছে ‘বাহাই সেন্টার’। এছাড়া আরো কয়েকটি বাহাই সেন্টার রয়েছে।
বাহাই বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় ইতিহাস ঈশ্বরের দূতদের ধারাবাহিক আগমনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে নিজ সময়কালের মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদের মাঝে আছেন ইব্রাহিম, গৌতম বুদ্ধ, যিশু, মুহাম্মদ (স.) ও অন্যান্যরা। সর্বশেষে আছেন বাহাউল্লাহ।
বাহাই শিক্ষা ও মতবাদের ভিত্তি তিনটি মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত- ঈশ্বরের ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, এবং মানবজাতির ঐক্য। এসকল স্বীকার্য বলে ঈশ্বর নির্দিষ্ট সময় পর পর তাঁর ইচ্ছা দূতদের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। আর এসকল দূতগণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতির চরিত্র পরিবর্তন ও উন্নয়ন।
বাহাউল্লাহ বলেন, ‘ঈশ্বর ঐতিহাসিক শক্তির বলে যে গতি সৃষ্টি করেছেন তা বংশ, শ্রেণী, গোত্র, ও জাতির মধ্যে প্রচলিত বাধা ভেঙে ফেলছে এবং যথাসময়ে একটি সার্বজনীন সভ্যতার জন্ম হবে’।
বাহাই বিশ্বাসের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির এই একতাবদ্ধ হওয়াকে সম্ভব করে তোলা। বাহাউল্লাহ শিক্ষা দেন ঈশ্বর এক, মানবজাতি এক এবং পৃথিবীর সব ধর্ম হচ্ছে এক ঈশ্বরের বিভিন্ন সময়ের প্রকাশ।
বাহাউল্লাহ বলেন, ‘যেকথাটি পৃথিবীর সব ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, সেই সময় এসেছে পৃথিবীর সব মানুষকে একটি শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজে একতাবদ্ধ করার’। আরো বলেন, ‘এই পৃথিবী হচ্ছে একটি দেশ, ও মানবজাতি হচ্ছে তার নাগরিক’।
একটি বৈশ্বিক সমাজের জন্য বাহাউলস্নাহ বলেন, কয়েকটি মৌলিক নীতি প্রয়োজন। এর মধ্যে থাকা উচিত: যেকোনো সংস্কার থেকে মুক্তি, সব লিঙ্গের মধ্যে সম্পূর্ণ সমতা, দারিদ্র ও প্রাচুর্যের চরম পার্থক্য দূর করা, সার্বজনীন শিক্ষা, বিজ্ঞান ও ধর্মের ঐক্যতান, প্রকৃতি ও প্রযুক্তির মধ্যে টেকসই সুষম সম্পর্ক, এবং সম্মিলিত নিরাপত্তা ও এক মানবতার ভিত্তিতে একটি বিশ্বব্যাপী ফেডারেল পদ্ধতির প্রবর্তন।
এছাড়া ধর্মের অন্যান্য বিশ্বাস থেকে কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো-
আল্লাহ: সৃষ্টির উর্ধ্বে অবস্থানকারী এক অজেয় সত্তা হচ্ছেন আল্লাহ্। তার কাছে পৌঁছানোর সকল রাস্তা অবরুদ্ধ। এজন্য ‘বাব’ এর প্রয়োজন। বাহাইগণ আতীন্দ্রিয় সর্বোশ্বরবাদের বিরোধী। অতীন্দ্রয়বাদীরা কেবল তাদের নিজস্ব কল্পনা বা ধারণার চিত্র অঙ্কন করেছেন। এমনকি মহত্তম আত্মা এবং পবিত্রতম হৃদয় তা যতই উচ্চ ও উন্নত হোক না কেন- বিজ্ঞানের ও আধ্যাত্মিকতার জগতে যত উচ্চেই বিচরণ করুক না কেন নিজেদের আভিজ্ঞতার পরিমণ্ডল অতিক্রম করতে পারে না।
সৃষ্টি: আল্লাহ আজ্ঞেয় সত্তারূপে নিজেকে সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করে। বস্তুর সূচনা হয় সৃষ্টি ও নির্গমনের মাঝখানে। বাহাই গ্রন্থগুলি খালক (সৃষ্টিকর্তা) শব্দটি বহাল রাখতে চায়। কিন্তু একই সাথে বলে যেহেতু খালিক এর গুণাবলী নিত্য ও চিরস্থায়ী, তাই এমন কোন সময় ছিলো না জগতের অস্তিত্ব ছিলো না।
নবী: আল্লাহ অভিব্যক্তির একটি বিশেষরূপ নবীদের মাঝে ব্যক্ত হয়েছে। তবে অবতারবাদের ধারণা গ্রহণ করা হয়নি। নবীর ভিন্ন দু’টি শর্ত থাকে: তিনি একজন মানুষ কিন্তু একটি স্বচ্ছ আয়না। এছাড়া কোন মানুষ যতই পূর্ণাঙ্গ হোক বা যোগ্যতা অর্জন করুক না সে নবীর মর্যাদা অর্জন করতে পারে না।
আত্মা: বাহাই মনস্তত্ত্ব কিছুটা জটিল। আত্মাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- জীবাত্মা, উদ্ভিদ আত্মা, মানবাত্মা, আত্মপ্রত্যয় আত্মা ও পবিত্র আত্মা।
(দিরিপোর্ট২৪/ডব্লিউএস/এমডি/নভেম্বর ১১, ২০১৩)