দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বিএনপি চেয়ারপারসনের নাতনি সম্পর্কে আপত্তিকর ও অশ্লীল মন্তব্য এবং ফাঁস হওয়া ফোনালাপে চিত্রনায়িকা মাহিকে ধর্ষণের হুমকি কাণ্ডে প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো ডা. মুরাদ হাসান একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। বিষয়টি এবার নিশ্চিত করেছেন ময়মনসিংহে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। একই দাবি গতকাল (সোমবার) এক অনুষ্ঠানে করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তবে সোমবার দুপুরে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় ফখরুল যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই কথা বলেন তখন দর্শকসাঁরিতে থাকা যুবদলের এক নেতা তার বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে সভায় হট্টগোল বেঁধে যায় এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয় কিছুক্ষণের জন্য।

মির্জা ফখরুল তার বক্তব্যে বলছিলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জঘন্য, নিকৃষ্ট কথাবার্তা বলছেন একজন ভূঁইফোঁড় ডাক্তার। শুনেছি, সে সম্ভবতঃ জামালপুরের সরিষাবাড়ীর। এটাও শুনেছি, সে নাকি একসময় ছাত্রদল করতো। দুঃখের কথা, দুর্ভাগ্যের কথা! আগে সে ছাত্রদল করতো। সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রচার সম্পাদক ছিল। পরবর্তীকালে সে ছাত্রলীগে যোগদান করেছে। ধিক্কার দিই আমি তাকে। শেইম’- কিন্তু এ পর্যায়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীন দাঁড়িয়ে ফখরুলের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

মমেক ছাত্রদলের সেই কমিটিতে প্রচার সম্পাদক হিসেবে মুরাদের নাম ৭ নম্বরে ছিল

মমেক ছাত্রদলের সেই কমিটিতে প্রচার সম্পাদক হিসেবে মুরাদের নাম ৭ নম্বরে ছিল

তিনি চেঁচিয়ে বলেন, ‘মুরাদ ছাত্রদল করে নাই।’ শাহীন শুধু একথা বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি নিজের মূল দলের মহাসচিব ফখরুলকে বক্তব্য প্রত্যাহারেরও দাবি জানান। এ সময় মহাসচিবের সঙ্গে প্রকাশ্য বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন শাহীন। মির্জা ফখরুল তাকে থামাতে ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে ‘বেআদপ’ বলে ভর্ৎসনাও করেন।

মির্জা ফখরুল শাহীনকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, ‘ইউ ডোন্ট নো। তুমি বাজে কথা বলবে না। তুমি জানো না। আমি জেনে বলছি।’

তারপরও শাহীন মহাসচিবের সঙ্গে তর্ক চালিয়ে গেলে পুরো মিলনায়তনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ সময় ফখরুল তাকে চুপ করতে এবং দর্শক সাঁড়ি থেকে মঞ্চে আসতে বলেন। মঞ্চে থাকা বিএনপির অন্য নেতারাও হাত উঠিয়ে তাকে চুপ করতে বলেন। কিন্তু যুবদল নেতা শাহীন চুপ হতেই চাইছিলেন না।

এ সংক্রান্ত এক রিপোর্টে মঙ্গলবার একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে- বিএনপির ওই অনুষ্ঠানে “উপস্থিত নেতাদের একজন (পত্রিকাটিকে বলেন), ডা. মুরাদকে নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হলে তারা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তার জীবনী দেখেছেন। সেখানে কোথাও ছাত্রদল করার তথ্য নেই। আবার যে সময়টার কথা বিএনপি মহাসচিব বলছেন, সেই ১৯৯৪ সালে ডা. মুরাদ ছাত্রলীগ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখার ‘কার্যকরী সদস্য’ ছিলেন বলে ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে। ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান নেতারাও ফখরুলের দাবি মানতে নারাজ।”

কিন্তু আজ মঙ্গলবার যমুনা টিভির এক সচিত্র প্রতিবেদনে প্রমাণসহ প্রকাশ করা হয় মুরাদের ছাত্রদল সংশ্লিষ্টতার তথ্য। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের কমিটিতে পদও ছিল মুরাদ হাসানের। তিনি ছিলেন প্রচার সম্পাদক। তবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- নানা অপকর্মের অভিযোগও ছিল মুরাদের বিরুদ্ধে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি যোগ দেন ছাত্রলীগে। অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত তিনি ছাত্রদলে ছিলেন।

ডা. মুরাদের বাবা মতিউর রহমান তালুকদার ছিলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির ছেলে ছাত্রদলের কমিটিতে রয়েছে- এই বিষয়টি নিয়ে মতিউর রহমান ঘনিষ্ঠজনদের কাছে আক্ষেপ করতেন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি সাইদ মেহেবুব উল কাদির সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মুরাদ ছাত্রদলের মিছিল করেছে, মিটিং করেছে, সংগঠনের কার্যক্রম করেছে এবং পরবর্তীতে যখন কমিটি হয়েছে তখন কমিটিতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তার অ্যাক্টিভিটিস দেখে তখন আমরা তাকে প্রচার সম্পাদক (পদ) দেই।’

ডা. মুরাদ হাসান ছাত্রদলের যেই কমিটিতে ছিলেন তার অনুমোদন দেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বরাবরই সুবিধাবাদী ছিলেন মুরাদ। সে হলো পল্টিবাজ নেতা। তার অনেক উচ্চাকাঙ্খা আছে। সেজন্য সে ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে চলে গেছে।’

প্রথমদিকে মুরাদের ছাত্রদলে যোগদানের কারণ প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন বলেন, ‘ছাত্রদল করলে ওখানে তারা একটু ভালোভাবে চলতে পারবে, একটু... মানে মাতব্বরি করতে পারবে- এই ধরনের মনমানসিকতা নিয়ে আমার মনে হয়...’

বর্তমানে ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির জৈষ্ঠ আহ্বায়ক আবু ওয়াহাব আকন্দ জানান, বাগমারার হোস্টেল এলাকায় মদ্যপ এবং ফেনসিডিল সেবনকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুরাদ। যেখান থেকে তিনি ফেনসিডিল কিনতেন সেখানে পাওনা শোধ করতে না পারার কারণে তাকে একবার হাত-পা বেঁধে পরে গাছের সঙ্গেও বেঁধে রেখেছিল স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা।

বিতর্কিত মন্তব্য আর অডিও ফাঁসের সূত্রে মন্ত্রীত্ব (প্রতিমন্ত্রী) হারানোর পর ডা. মুরাদ হাসান এমপি’র অতীত সম্পর্কিত নানান বিতর্কিত বিষয়বস্ত বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এখন। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ঘটনায় নিজ দল আওয়ামী লীগেও সমালোচিত-নিন্দিত হচ্ছিলেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে (মমেক) ডা. মুরাদের ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল ছাত্রদল দিয়ে। ১৯৯৩ সালে এম-৩০ ব্যাচে তিনি এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। এরপর তিনি ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত হন। এরপর মমেক ছাত্রদল কমিটির প্রচার সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে ক্ষমতার পালাবদলে ভোল পাল্টে ছাত্রদলের পদধারী নেতা থেকে হন মমেক ছাত্রলীগের সভাপতি।

আরও জানা গেছে, ছাত্রদলের মমেক শাখা ১৯৯৬-৯৮ কমিটির প্রচার সম্পাদক হিসেবে চার-পাঁচ মাস দায়িত্বপালন করেন ডা. মুরাদ হাসান। তখন ছাত্রদলের মমেক শাখার সভাপতি ছিলেন সৈয়দ মেহবুব উল কাদির আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইসহাক। পরে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রদল থেকে পদত্যাগ করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন মুরাদ। একপর্যায়ে মমেক শাখা ছাত্রলীগ সভাপতির পদ পান তিনি। শেষতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আজ (৭ ডিসেম্বর) পদত্যাগপত্র জমা দেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ০৮ ডিসেম্বর, ২০২১)