সবারই লক্ষ্য নির্বাচন, তবু পার্থক্য
দি রিপোর্ট২৪ প্রতিবেদক : নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবিতে টানা ৮৪ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালন করছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। অন্যদিকে দলীয় অথবা সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য নেতাদের কাছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট। প্রধান দুই দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের লক্ষ্য নির্বাচন প্রশ্নে এসে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। বিরোধ শুধু নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতিতে।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে বিরোধ প্রশ্নে দেশের রাজনীতিতেও চলছে অচলাবস্থা। জনমনে দেখা দিয়েছে আতংক ও আশঙ্কা। কী হয়, কী হবে, কী ঘটতে যাচ্ছে এ প্রশ্ন হাজারো মানুষের। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর পাওয়া গণতন্ত্র টিকবে কি না, এমন প্রশ্ন এখন কোটি মানুষের।
গত রবিবার থেকে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের টানা ৮৪ ঘণ্টার হরতাল চলছে। একই দিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রির কার্যক্রম চলছে সমারোহে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে এ উপলক্ষে চলছে উৎসবের আমেজ। মনোনয়ন প্রার্থীরা নিজেদের অনুগত কর্মী বাহিনী সঙ্গে নিয়ে মনোনয়ন ফরম ক্রয় করতে আসছেন। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে আনন্দ উল্লাস, স্লোগানের মাধ্যমে দিচ্ছেন নিজেদের শক্তিমত্তার ব্যাপক মহড়া।
অন্যদিকে বিরোধী দল এই নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাসায় কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি ও অভিযোগ করা হচ্ছে। হরতালের সপক্ষে দলটির নেতাকর্মীরাও মাঠে নামতে পারছে না। করতে পারছে না কোনো ধরনের ন্যূনতম পিকেটিং। সংখ্যায় নগন্য হলেও বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মী দেখলেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তেড়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি গুলিও চালাচ্ছে। প্রতিদিনই সারাদেশে বিপুল সংখ্যক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী আহতের খবর সংবাদ মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। আবার সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা মোটর সাইকেল মহড়া দিচ্ছে প্রকাশ্যে। হরতাল প্রতিহত করার নামে দলটির নেতাকর্মীরা পাড়া-মহল্লার মোড়ে জড়ো হচ্ছে। প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। সঙ্গে চলছে খাওয়া-দাওয়ারও পর্ব। করছে নির্বাচনের পক্ষে নেতাকর্মীদের সংগঠিত। অপরদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও হামলা চালাচ্ছে বলে বিরোধী দল অভিযোগ করে আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম দি রিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, দুই দলের দুই ধরনের কর্মকাণ্ডে দেশ একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমার ব্যক্তিগত অভিমত সংলাপ হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, সংলাপ না হলে যা হবে তা হচ্ছে- প্রথমত আওয়ামী লীগ চাইবে তাদের অধীনেই বিএনপি নির্বাচনে আসুক। অথবা বিএনপিকে ছাড়াই তারা নির্বাচন শেষ করবে। দ্বিতীয়ত বিএনপি চাচ্ছে-তাদের নির্দলীয় সরকারের দাবি ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই মানতে হবে। অথবা গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে।
ড. পিয়াস করিম আরও বলেন, দুই দলের এ ধরনের মানসিকতার ফলে তৃতীয় একটি অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিক্রিকে ‘নীল নকশার নির্বাচনের’ পাঁয়তারা বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এটা আজ পরিষ্কার, তারা নীল নকশার নির্বাচন করতে চায়। এজন্য চলমান সংকটের সমাধান না করেই সরকার একতরফা নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে।
রিজভী বলেন, বিরোধী দলের দাবি একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, যাতে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। এটা সমাধানের জন্য বিরোধীদলীয় নেতা সংলাপের আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ ‘বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একদলীয় এই প্রহসনের নির্বাচন’ মেনে নেবে না।
সরকার ‘একদলীয় নির্বাচনের পথে চলা’ বন্ধ না করলে ‘গণঅভ্যুত্থানে’নির্দলীয় সরকারের ফয়সালা করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা জামাল হায়দার দি রিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, আমাদের পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আজকে (সোমবার) স্পষ্টভাবে বলেই দিয়েছেন, দেশ অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সকল দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, প্রধান বিরোধী দল ছাড়া সর্বদলীয় সরকার গঠনও সমীচিন হবে না। সকল দল অংশ না নিলে সরকারের নির্বাচন প্রস্তুতি ও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিক্রি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই নির্বাচন প্রস্তুতির আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আসা।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন দি রিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তা সংবিধান অনুযায়ী হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে আমরা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছি। জনগণ অতীতের মতোই আগামী নির্বাচনে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে এই নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি দি রিপোর্ট২৪ ডটকমকে বলেন, সরকার একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে না। এমন নির্বাচনের ফলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। সরকারের মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু তারা মন্ত্রী থাকবেন কি থাকবেন না, সে বিষয়টি স্পষ্ট না। সংবিধান অনুযায়ী তারা মন্ত্রী থাকেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরিত্র অনুযায়ী সব কিছুই সম্ভব।
বিরোধী দলের আন্দোলন সম্পর্কে সাকি বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি মীমাংসিত বিষয় হলেও এই পদ্ধতি দেওয়ার ব্যাপারে বর্তমান বিরোধী দলেরই এক সময় আপত্তি ছিল। পরর্বতীতে বাধ্য হয়ে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়কের মূল দাবিদার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই মীমাংসিত বিষয়টিকে বাতিল করে দেয়। এখন দেখা যাচ্ছে বিএনপি ওই পদ্ধতির জন্য আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগ বিএনপির আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য ছিল না। শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই তারা এ আন্দোলন করেছে ও করছে। জনগণ তাদের চরিত্র সম্পর্কে জানে। তাই বিএনপি তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না।
(দিরিপোর্ট২৪/টিএস-সাআ-বিকে-আরএইচ/এইচএস/এইচএসএম/নভেম্বর ১১, ২০১৩)