মিউজিক ভিডিও থেকে ছদ্মবেশী দুর্ধর্ষ খুনির সন্ধান
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বগুড়া শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজের অবস্থান জানান দিতে তিন জনকে হত্যা করে হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিম ওরফে খুনি হেলাল (৪৫)। ওই হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলা থেকে নিজেকে আড়াল করতে গত ২০ বছর ধরে বাউল ছদ্মবেশে ঘুরছে সে। হত্যাকাণ্ডের পর ভৈরব স্টেশনে গান গেয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে এবং দ্বিতীয় বিয়ে করে। মূলত হত্যাকাণ্ডের সাজা থেকে বাঁচতেই তার এসব কৌশল।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছদ্মবেশী সেই বাউল হেলাল হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে র্যাব। বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ সব তথ্য জানান বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, আনুমানিক ৬ মাস আগে জনৈক ব্যক্তি ইউটিউবে প্রচারিত একটি গানের বাউল মডেল সম্পর্কে র্যাবের কাছে তথ্য দেয় যে, ওই মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। এমন তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মামলার ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব। এক পর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়। বাউলের বেশ ধারণ করা আসামিকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-৩ এর অভিযানে গতকাল বুধবার (১২ জানুয়ারি) রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে মো. হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিম ওরফে খুনি হেলালকে (৪৫) গ্রেপ্তার করা হয়। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া। পিতা মৃত নুরুল ইসলাম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত হেলাল তার অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, তার বিরুদ্ধে যে ৩টি হত্যা মামলা রয়েছে, সবগুলোই বগুড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। সে বগুড়ার একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা, ২০০১ সালে বগুড়ার চাঞ্চল্যকর বিদ্যুৎ হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি সে। এছাড়া ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলার আসামি ছাড়াও ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় দায়ের করা একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে সে গ্রেফতার হয়। ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ২০০০ সালে বগুড়া শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে বামহাতে আঘাত পায় সে এবং একপর্যায়ে বামহাত পঙ্গু হয়ে যায়। এ ঘটনার পর থেকে এলাকায় এসে হাত লুলা হেলাল নামেও পরিচিত ছিল সে।
গ্রেপ্তার হেলালকে সিরিয়াল কিলার হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়ার কারণ সম্পর্কে র্যাব জানায়, তার বক্তব্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত তিনটি হত্যা মামলায় সে জড়িত। ২০০৯ সালের পর ঘটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য আমরা সহজেই পেয়ে যাই। কিন্তু এর আগের তথ্য থানা থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আমরা যখন তাকে থানা পুলিশে হস্তান্তর করবো, তখন থানা পুলিশও এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে। পরে তারাও আরো কোনো মামলার সংশ্লিষ্টতা পেতে পারে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হেলাল হোসেন আমাদের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি, বগুড়ায় ২০০১ সালের বিদ্যুৎ হত্যাকাণ্ডের চার আসামির মধ্যে সে একজন। ওই হত্যাকাণ্ডের মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। বগুড়ায় ১৯৯৭ সালে সংঘটিত আরও একটি হত্যা মামলারও আসামি তিনি। একইসঙ্গে ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলারও আসামি তিনি। এছাড়াও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের একটি মামলা এবং চুরির একটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হত্যা মামলায় সাজা হওয়ার পর এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনের জন্য বাউলের বেশ বেছে নেয় হেলাল। এভাবেই দেশের বিভিন্ন স্টেশনে গত সাত বছর আত্মগোপনে ছিলেন হেলাল। বাউলের বেশ ধরে গান গেয়ে জীবিকাও নির্বাহ করেছেন তিনি।
যেভাবে মিউজিক ভিডিওতে হেলাল
নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’ গানটির শুটিং চলার সময় গানটির পরিচালক বলেন, ‘একজন বাউল মডেলের প্রয়োজন।’ তখন স্থানীয়রা পরিচালককে হেলালের কথা বলেন; যিনি নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনে ‘সেলিম ফকির’ নামে পরিচিত ছিলেন। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে ওই মিউজিক ভিডিওতে তাকে নেওয়া হয়।
এরপর নারায়ণগঞ্জ থেকে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে চলে যান হেলাল হোসেন। সেখানে প্রায় চার বছর অবস্থান করেন। সেখানে বিয়েও করেন তিনি।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/১৩ জানুয়ারি, ২০২২)