নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন
সুগন্ধায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় ১২ জনের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনায় চারজন সরকারি কর্মকর্তা, লঞ্চের চারজন মালিক ও লঞ্চ পরিচালনায় অংশ নেওয়া আরও চারজনের সংশ্লিষ্টতা ও দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পেয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
এ ছাড়া জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনাসহ ২৫ দফা সুপারিশ জানিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি চাঁদপুর ঘাট অতিক্রম করার পর ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয় এবং অস্বাভাবিক শব্দ করছিলো। ইঞ্জিনের ত্রুটি সারাতে ব্যর্থ হওয়ায় লঞ্চটি না চালিয়ে নিরাপদ ঘাটে ফেরানোর জন্যও যাত্রীরা অনুরোধ করেছে। কিন্তু লঞ্চের মাস্টার ও ইঞ্জিন ড্রাইভার কোনও কর্ণপাত না করে ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে লঞ্চটি চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুধু মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারকে শাস্তি না দিয়ে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনাসহ ২৫ দফা সুপারিশ জানিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি। তারা দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন, টাকার পরিমাণ নির্ধারণ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করারও সুপারিশ করেন।
নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আশীষ কুমার দে বলেন, দুর্ঘটনার জন্য ৪ জন সরকারি কর্মকর্তা, ৪ জন লঞ্চ মালিক, লঞ্চের দুইজন মাস্টার ও দুইজন ড্রাইভার দায়ী।
নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবু নাসের খান জানান, আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সরকার যেন তাদের চিহ্নিত করে। তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দেয়। সিস্টেমিক ফল্টগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করব। এগুলো যেন সরকার পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করে।
তদন্ত কমিটির অন্যান্য সুপারিশগুলো হলো- প্রত্যেক যাত্রীবাহী নৌযানে আনসার/সিকিউরিটি থাকা বাধ্যতামূলক করা, যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষ, প্রবেশপথ, মাস্টারব্রিজসহ স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা, যে কোনো নৌযানের নকশায় অগ্নি-নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত, সে অনুযায়ী নকশা অনুমোদন এবং যথাযথভাবে নকশা অনুসরণ করে নৌযান নির্মাণ করা, নতুন নৌযানে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক আছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে ফায়ার সার্ভিস বিভাগের ছাড়পত্র গ্রহণ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক প্রতি তিন মাস পরপর তা পরীক্ষা করা, চলমান নৌযানগুলো বিশেষ করে লঞ্চ ও অন্যান্য যাত্রীবাহী নৌযানের অগ্নি-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা, তা আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করা, লঞ্চের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার না করা, ইঞ্জিন কক্ষের পাশ থেকে খাবারের হোটেল সরিয়ে নেওয়া এবং ইঞ্জিন কক্ষ ও ক্যান্টিনের আশেপাশে জ্বালানি তেলসহ কোনো দাহ্য পদার্থ রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, নৌযানের ইঞ্জিন কক্ষে আগুন লাগলে তা দ্রুত নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সরবরাহ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।
সুপারিশে আরও বলা হয়, নৌযানের কর্মীদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পরিচালনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক ও বছরে অন্তত এক বার মহড়ার ব্যবস্থা করা, প্রত্যেক নাবিকের ইউনিফর্ম পরিধান বাধ্যতামূলক করা, আইএসও ৫৮(ক) ধারা মোতাবেক যাত্রীবাহী নৌযানের বিমা অথবা নৌ দুর্ঘটনা ট্রাস্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করা, যে কোনো নৌ-দুর্ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অভিজ্ঞ নৌ-স্থপতি, নৌ-প্রকৌশলী, পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, মাষ্টার মেরিনার, নৌ পরিবহনবিষয়ক গবেষক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী এবং নৌ মন্ত্রণালয়, নৌ অধিদপ্তর, নৌযান মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় তদন্ত কমিটি গঠন।
এর আগে, এই হতাহতের ঘটনায় লঞ্চটির চারজন মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারদের দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দেয় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি।
গত ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে যাওয়া এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ সময় লঞ্চটিতে প্রায় ৮০০ যাত্রী ছিলেন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত অর্ধশত যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হন আনুমানিক ১৫০ জনের বেশি যাত্রী।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২২ জানুয়ারি, ২০২২)