সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই খটকা লেগেছিল : বিচারক
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। কেননা আমার মনে খটকা লেগেছিল, সিনহার পরিচয় জানার পর স্যালুট দিয়েছিলেন চেকপোস্টে থাকা সদস্যরা। এর একটু পর তাঁরাই কেন আবার গুলি করতে সহযোগিতা করলেন-রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ার সময় একথা বলেন বিচারক।
এর আগে বেলা ২টা ২০ মিনিটে এজলাসে উপস্থিত হয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাঈল ৩০০ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া শুরু করেন।
এর আগে, সকালে এই মামলার সকল আসামিকে আদালতে আনার কথা থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করা হয়। পরে দুপুর ১টা ৫৭ মিনিটের দিকে আসামিদের আদালতে আনা হয়। তাঁদের আদালতের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। সাবেক ওসি প্রদীপ আদালতে উপস্থিত হয়েছেন ধূসর রঙের সোয়েটার আর নেভী ব্লু রংয়ের প্যান্ট পরে। এজলাসের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
রায়কে কেন্দ্র করে আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রায় শুনতে আদালতে রয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়। তাঁদের বেশিরভাগই টেকনাফের বাসিন্দা।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এ প্রথম এত দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হচ্ছে। এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার নজির নেই। নজির নেই এত স্বল্প সময়ে চার্জগঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেরও। সবকিছু যেন অবিশ্বাস্য গতিতেই এগিয়েছে। তাই সবার দৃষ্টি এখন এ রায়ের দিকেই।
সেই মতেই সবকিছুর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সোমবার সকাল হতেই পুরো আদালত পাড়ায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সবখানেই পিনপতন নীরবতা। আদালত পাড়ার চারপাশে, পয়েন্টে পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে নিরাপত্তাকর্মী। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃংখলা বাহিনীর নানা বিভাগের লোকজন কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘিরে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেদিকে পুলিশের সর্বচ্চো নজর রয়েছে। আদালতে নিরাপত্তার স্বার্থে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এ প্রথম এত দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হচ্ছে। এ মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মাঝে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার নজির নেই। মাত্র ৩৩ কার্য দিবসে আমরা এ মামলার সকল বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। তেমনি সক্ষম হয়েছি সিনহা হত্যার বিষয়টি প্রমাণে। আমাদের আশা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন প্রদীপ ও অভিযুক্তরা।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে খুন হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
এ ঘটনার পাঁচ দিন পর ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। তিন নম্বর আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে। আদালত মামলাটির তদন্তভার দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫-কে। এরপর বেরিয়ে আসে মূল ঘটনা।
৭ আগস্ট মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর ২৪ আগস্ট মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসেন।
চার মাসের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে সিনহা হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে অতিরিক্ত ডিআইজি এবং লে. কর্নেল মর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তাকে সদস্য করে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। এক মাসের মাথায় তদন্ত কমিটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পুলিশের হঠকারী (অবিমৃশ্যকারী), প্রস্তুতিহীন ও অপেশাদারি আচরণ বলে উল্লেখ করে। এ ছাড়া যথাযথ তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে গুলিবর্ষণের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের মনে অসংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। আত্মরক্ষার আইনি সুবিধার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এসব বন্ধে কমিটি ১৩ দফা সুপারিশ করে।
তাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপের ৩৩ মাসের সময়কালে ১০৬টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় ১৭৪ ব্যক্তি নিহত হন।
মামলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিনহা তার দলের সঙ্গী সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে ভ্রমণবিষয়ক তথ্যচিত্র ‘টাইম ল্যাপস’ ভিডিও করতে গিয়েছিলেন। এ সময় মেজর সিনহা ও তার সঙ্গীরা টেকনাফের নিরীহ মানুষের ওপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি’ জেনে যান। প্রদীপের অত্যাচারের শিকার কিছু মানুষের সাক্ষাৎকারও তারা নিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে প্রদীপের সঙ্গেও সিনহা ও তার সঙ্গীদের কথা হয়। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে প্রদীপের পরিকল্পনায় শামলাপুর চেকপোস্টে সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।
আলোচিত এ মামলায় এখন কারাগারে আছেন ১৫ আসামি। তারা হলেন বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী; টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার দেহরক্ষী রুবেল শর্মা; বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের বরখাস্ত এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত; বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাগর দেব; বরখাস্ত এএসআই লিটন মিয়া; বরখাস্ত এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান; বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ; টেকনাফ থানায় পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/৩১ জানুয়ারি, ২০২২)