দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: কফিনে মোড়ানো হিমেলের নিথর দেহ। কফিনের সামনে চেয়ারে বসে আছেন তার মা মনিরা ইয়াসমিন। অপলক দৃষ্টিতে কি যেন ভাবছেন। মাঝে মাঝে এপাশ ওপাশ করে সবার দিকে চেয়ে দেখছেন। অনেকে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন কিন্তু তার চোখে পানি নেই। তাঁর যে সন্তান আর বেঁচে নেই! তার সামনেই যে তার সন্তানের কফিন হয়ত সেটা তিনি অনুধাবন করতে পারছেন না।

নিহত হিমেলের মামার বাসায় থাকা ভাড়াটিয়া লিটনের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ বছর আগে হিমেলের বাবা মাহবুব হাসান হেলাল মারা যায়। এই শোকেই স্ট্রোক করে হিমেলের মা মনিরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর থেকেই তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টায় ক্যাম্পাসের ভেতরে হাবিবুর রহমান হলের সামনে একটি বেপরোয়া ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হিমেলকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবীব হিমেলের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পাঁচ ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নির্মাণাধীন ভবনেও ভাঙচুর চালায়। এ সময় প্রোক্টর লিয়াকত আলী ঘটনাস্থলে আসলে তাকে ধাওয়া করে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। এরপর দুই ঘণ্টা ওই অবস্থায় লাশ পড়ে থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক) নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিন রাতে শিক্ষার্থীরা ৬-দফা দাবি তুলে আন্দোলন চালিয়ে যান। দাবিগুলো হলো- প্রোক্টরিয়াল বডির পদত্যাগসহ নিহতের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া, নিহত শিক্ষার্থীর বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি প্রদান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাল্টানো এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও হিমেল নিহতের ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিচার করা। পরে বুধবার প্রথম প্রহরে প্যারিস রোডে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে প্রোক্টরিয়াল বডিকে প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।

আরও পড়ুন.. হিমেলের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করবে প্রশাসন : রাবি ভিসি

বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় নিহত হিমেলের মরদেহ রামেক থেকে প্রথমে চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। এখানে নিহতের শিক্ষক এবং বন্ধুবান্ধব সকলে হিমেলের মরদেহের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা মুক্তমঞ্চে নিহত হিমেলের কফিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠন শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মরহুমের প্রথম জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় নিহত হিমেলের পরিবারের সারা জীবনের ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে বলে জানান রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।

জানাযা শেষে হিমেলের মরদেহ তার মামার বাসা সংলগ্ন নাটোরের নববিধান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে স্থানীয় প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনগণ তাকে শ্রদ্ধা জানায়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিমেলের মায়ের হাতে তাৎক্ষণিক পাঁচ লাখ টাকার চেক তুলে দেন। পরে নাটোর পৌর ঈদগাহ্ ময়দানে হিমেলের দ্বিতীয় জানাযার নামাজ শেষে তাকে নাটোরের গাড়িখানা কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।

কথা হয় নিহত হিমেলের নানা খন্দকার মনিরউদ্দীন মনির এবং খালা মিলিনা আক্তারের সঙ্গে। তারা দাবি জানিয়ে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে আর দ্বিতীয় কোনো শিক্ষার্থীকে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট না হতে হয়। প্রশাসন যাতে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পাশাপাশি ঘাতক ড্রাইভারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন তারা।

এদিকে বুধবার দুপরে হিমেলকে চাপা দেওয়া ট্রাকের চালককে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এছাড়া শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে প্রোক্টরকে প্রত্যাহার করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আসাবুল হককে নতুন প্রোক্টরের দায়িত্ব দিয়েছে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার। নবনিযুক্ত প্রোক্টর বুধবার দুপরে তার কর্মস্থলে যোগদান করেছেন।

এছাড়া বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভায় শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে নিহত হওয়া রাস্তা এবং নির্মাণাধীন বিজ্ঞান ভবনের নামকরণ হিমেলের নামে করা হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)