দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ইক্যুয়িটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনরশিপ ফান্ডের (ইইএফ) ৭০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে একটি চক্র। আরো ৪২ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার সময় ধরা পড়লো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

সাবেক ইক্যুয়িটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনরশিপ ফান্ড (ইইএফ) থেকে ৭০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল মানিকখালী ডেইরি ফার্ম নামে ময়মনসিংহের একটি প্রতিষ্ঠানকে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত লেগে থেকে চক্রটি এই টাকা তুলে আত্মসাৎ করে। এরপর আরও ৪২ লাখ টাকা ওই চক্রটির হাতে তুলে দেওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এই তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎপরতায় ওই টাকা তুলে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বের হয়ে আসে, মানিকখালী ডেইরির নামে যে আবেদনটি (ইওআই) প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সেটা কয়েক হাত ঘুরে আবার আইসিবিতে জমা পড়ে। অথচ ময়মনসিংহে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই।

তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তার লক্ষ্যে গঠিত সরকারি ওই তহবিলের অর্থ আত্মসাতের ওই ঘটনায় একের পর এক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেও আইসিবি কেনো প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি চার বছরে আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধার করতে আইসিবি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি সংস্থাটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ইইএফ নামক সরকারি ওই তহবিল ব্যবস্থাপনায় আইসিবির ব্যাপক গাফিলতির একটি উদাহরণ এই মানিকখালী ডেইরি ফার্ম। কারণ, কৃষিভিত্তিক ওই প্রকল্পে একের পর এক তথ্য জাল করার ঘটনা জেনেও আইসিবি চক্রটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইইএফের অর্থায়ন করা স্বপ্ন এগ্রো ফার্ম নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৭ দিনের জন্য ৩০টি গরু ধার নিয়েছিল মানিকখালী ডেইরি ফার্ম। এ বিষয়ে একটি চুক্তিও করেছিল প্রতিষ্ঠান দুটি। তবে ওই গরু ফেরত না দিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দেয় মানিকখালী ডেইরি ফার্ম। পরে স্বপ্ন এগ্রো ফার্মকে ১৮ লাখ টাকার চেক দেয় মানিকখালী ডেইরি। ওই চেকের বিপরীতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেকগুলো ডিজঅনার হয়। এ কারণে স্বপ্ন এগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানিকখালী ডেইরির নামে মামলাও করেন। তারাই বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানান। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত শুরু করে ২০২০ সালে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত সূত্রে জানা যায়, মাহবুবা নূরজাহান এবং আজিজুর রহমান ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকখালী ডেইরি ফার্ম লিমিটেড নামের প্রকল্পের জন্য ইইএফের আর্থিক সহায়তা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেন। তবে তারা প্রকল্পের ধরন পরিবর্তন করে মৎস্য খামার করায় ইইএফের ঋণ অনুমোদন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ইইএফের অর্থায়নের শর্তে সংক্ষিপ্ত তালিকার প্রকল্পে কোনো ধরনের পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। তারপরও প্রকল্প মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর প্রকল্পটির ঠিকানা ও ধরন পরিবর্তন করা হয় পাঁচবার।

ডেইরি ফার্ম হিসেবে সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা ওই প্রকল্পটি মৎস্য প্রকল্পে রূপান্তর করায় প্রকল্প স্থান কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর চান্দপুর থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আতুয়াজঙ্গলে স্থানান্তর করা হয়। তবে বাস্তবে ওই ঠিকানায় কোনো প্রকল্প ছিল না এবং এর কোনো অস্তিত্বও পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল।

ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ার পর মাহবুবার স্বামী ওসমান গনি ওই আবেদনটি বিক্রি করে দেন। সঞ্জয় দত্ত নামের এক ব্যক্তি আবেদনটি কিনে নিয়ে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মে (আরজেএসসি) জাল নথিপত্র দিয়ে অদ্বৈত দাস নামের এক ব্যক্তিকে মানিকখালী ডেইরি ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ করেন। ওই অদ্বৈত দাস পরে একইভাবে জাল নথিপত্র দিয়ে ময়মনসিংহে ওই কোম্পানির নামে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকে হিসাব খোলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সঞ্জয় দত্তের প্রকৃত নাম বৈচিত্র্যময় দত্ত। ময়মনসিংহে ফারমার্স ব্যাংকে মানিকখালী ডেইরি ফার্মের নামে হিসাব খোলার সময় শনাক্তকারী হিসেবে বৈচিত্র্যময় দত্তের নাম ব্যবহার করা হয়। এই বৈচিত্র্যময় দত্ত ইইএফের অর্থায়নপুষ্ট পলাশকান্দা এগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

স্বপ্ন এগ্রোর সঙ্গে চেক জালিয়াতির একটি ঘটনায় ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর সঞ্জয় দত্তকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তদন্ত দলকে সঞ্জয় দত্ত জানান, মানিকখালী ডেইরি ফার্মের ঋণের আবেদনটি তিনি সাতক্ষীরার মোসাম্মৎ শাহানারার কাছ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় কিনে নেন। শাহানারা ওই আবেদনটি নরসিংদীর আমজাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে পান। আমজাদ জানান তিনি ওই আবেদনটি মাহবুবা নূরজাহানের স্বামী কিশোরগঞ্জের ওসমান গনির কাছ থেকে পান।

সঞ্জয় দত্ত ও অদ্বৈত দাস ওই আবেদনটি নিয়ে পরে নূরজাহান ও আজিজুরের তথ্য জাল করে কোম্পানির ধরন পরিবর্তন করে এবং অদ্বৈত দাস এমডির পদ নিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলেন। এ ঘটনায় ২০২০ সালের মার্চে ঢাকার পল্টন থানায় একটি জিডি করেন এবং কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে একটি মামলা করেন আজিজুর রহমান। এর পাশাপাশি মাহবুবা ও আজিজুর রহমান মিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে জালিয়াতির একটি অভিযোগ দায়ের করে।

তদন্তে জানা যায়, মানিকখালী ডেইরি ফার্মের নামে ময়মনসিংহে পূবালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় হিসাব খোলা হয়। এছাড়া ময়মনসিংহে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকেও একটি হিসাব ছিল ওই প্রতিষ্ঠানটির। পূবালী ব্যাংকে হিসাব খোলার সময় প্রকল্পটির চেয়ারম্যান মাহবুবা নূরজাহান যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন তারও কোনো অস্তিত্ব পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। হিসাব খোলার ফরমে অদ্বৈত দাস ও মাহবুবা নূরজাহানের স্বাক্ষরও ছিল না।

এছাড়া আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট থেকে পূবালী ব্যাংকের কাছে জানতে চাইলে ব্যাংক মানিকখালী ডেইরি ফার্মকে একটি সচ্ছল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘সলভেন্সি সার্টিফিকেট’ দেয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল দেখতে পায় ২০১৮ সালের ৩ জুন পূবালী ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির হিসাব খোলা হয় এবং এর পরের দিন ওই হিসাবে ৫ হাজার টাকা জমা করা হয়। এর বাইরে আর কোনো লেনদেন ছিল না।

এছাড়া প্রকল্পের অনুকূলে টাকা ছাড়ের আগে গ্যারান্টি হিসেবে আইসিবি কর্তৃক চেক চাওয়া হলে পূবালী ব্যাংকের পরিবর্তে ফারমার্স ব্যাংকের চেক দেওয়া হয়। নিয়মের ব্যত্যয় হলেও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি আইসিবি। ফারমার্স ব্যাংকে ওই প্রকল্পের হিসাব খোলা হয় ২০১৭ সালের ৬ জুন। ওই হিসাব খোলার সময়ও মাহবুবা নূরজাহানের প্রকৃত ছবি ব্যবহার করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, প্রকল্পটিতে নানা অসংগতি থাকা সত্ত্বেও আইসিবি মানিকখালী ডেইরি ফার্মের নামে ৭০ লাখ টাকা ছাড় করে। যা ২০১৮ সালের ২৪ আগস্ট পূবালী ব্যাংকের ওই হিসাবে জমা হয়। টাকা জমার পর মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চেকে সব টাকা তুলে নেন অদ্বৈত দাস ও তার লোকজনরা।

এই টাকা তুলে কোথায় খরচ করা হচ্ছে তার কোনো খোঁজ নেননি ওই প্রকল্পে আইসিবির মনোনীত পরিচালক আশরাফুল ইসলাম।

এসব ঘটনার কোনো কিছুই প্রকল্পটির মূল উদ্যোক্তা মাহবুবা নূরজাহান ও আজিজুর রহমান জানতেন না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলের কাছে দাবি করেন। পরিদর্শক দল দেখতে পায়, ওই দু’টি ব্যাংক হিসাব খোলার সময় মাহবুবা নূরজাহানের যে ছবি দেওয়া হয়েছে তা ছিল অন্য কোনো নারীর। এছাড়া ব্যাংক হিসাব খোলার সময় স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা, নূরজাহান ও আজিজুরের ওই প্রকল্পে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এমডি অদ্বৈত দাস এই জালিয়াতির হোতা। তিনি ব্যাংকে মানিকখালী ডেইরির নামে হিসাব খোলার সময় চেয়ারম্যান ও এমডির উভয়ক্ষেত্রে যোগাযোগের জন্য সঞ্জয় দত্ত নামের তৃতীয় এক ব্যক্তির নম্বর দেন। এই সঞ্জয় দত্তই পরে আইসিবির কাছ থেকে চেক গ্রহণ করে। যদিও অর্থায়নের নিয়মাবলিতে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা বা পরিচালকের পরিবর্তে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির হাতে চেক দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ কারণে আইসিবির কর্মকর্তাদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল জানায়, সঞ্জয় দত্ত প্রকল্পের পরিচালক বা উদ্যোক্তা না হয়েও নিজ স্বাক্ষরে আইসিবির কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকার চেক নেন। নীতিমালা বহির্ভূতভাবে এই চেক দেওয়াকে আইসিবির চরম গাফিলতি বলে মনে করছে পরিদর্শক দল।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অদ্বৈত দাস গ্রেপ্তার হলেও হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন।

জানা গেছে, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর আইসিবিতে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রকল্পের ধরন ও এমডি পরিবর্তনের পরও এ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন না তুলে দ্রুত অর্থছাড়ের পথে এগোয় আইসিবি।

প্রসঙ্গত, ইইএফ অর্থায়নপুষ্ট তহবিলে ৪৯ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে সরকার এবং সরকারের পক্ষ থেকে আইসিবি সেখানে একজন মনোনীত পরিচালক বসায়। কিন্তু মনোনীত পরিচালক আশরাফুল ওই প্রকল্পের টাকা রক্ষার জন্য কোনো ভূমিকাই নেননি।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৫ দফায় আইসিবিকে চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পায়নি। বিষয়টি সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো সহায়তাই করেনি আইসিবি।

জানা গেছে, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সঞ্জয় দত্তের কাছে মানিকখালী ডেইরি ফার্মের প্রথম কিস্তির ৭০ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করায় আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রহমানকে সন্দেহের তালিকায় রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/৭ ফেব্রুয়ারি,২০২২