[ বাংলা কবিতার নানা দিক নিয়ে বিদ্বৎ-সমাজে বিচার বিশ্লেষণ চলছে। এ নিয়ে এন্তার গবেষণা হচ্ছে, বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে তারা তাদের মতামত উপস্থাপন করছেন। এই সময়ের কবিতার নানা বিষয়-আশয় নিয়ে যে ক'জন বাংলা ভাষায় সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত; নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম একজন গবেষক ড. পাবলো শাহি। আমরা এখানে তাঁর একটি মৌলিক গবেষণা হাজির করছি, যা আমাদের বিবেচনায় মননশীল পাঠককে চিন্তার নতুন স্রোতধারার সাথে যুক্ত করবে। তা ছাড়া লেখাটি পূর্ণাঙ্গ বলে আমরা মনে করছি। বর্তমান লেখাটি দীর্ঘ হওয়ার কারণে এটি তিন কিস্তিতে পত্রস্ত করা হল। বর্তমান প্রবন্ধটিতে গবেষকের নিজস্ব বানান রীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। পাঠক, তাহলে আজ পড়ুন ১ম কিস্তি। বি.স. ]

রুটি আর ফুলের জন্য যুদ্ধ। দ্রোহ আর মাতৃভাষার অহম দিয়ে যার যাত্রা শুরু— সমাপ্তি অগ্নিবীণার মন্ত্রে; লাল-সবুজের পতাকা খচিত ভূখণ্ড-অর্জনে। যে লড়াই ও প্রতিরোধ বাঙালীর কৌমযুগ; চর্যাপদ থেকে শুরু হয়েছিল— চর্যার আকুতি তাই এক হয়ে মিশে গেল ’৭১-এর স্বাধীনতা, রক্তখোঁচিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতায়; লাশের কাফনে মোড়া বর্ণমালায়, বধ্যভূমির খাঁ-খাঁ শূন্য ধ্বনিগুঞ্জনমালায় ।

উত্তর ভারত থেকে আসা সেনদের হাতে পাল বংশের পতনের মধ্যদিয়ে বাঙালী প্রথম পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায়— বাঙালীর ও বাংলার কালো-কালপঞ্জির পাতায় যুক্ত হলো আর একটি নাম আর একটি অধ্যায়। ভেতরে জমে থাকা ১৭৫৭, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯-এর সাথে— ১৯৭১ একগুচ্ছ কাল-বিভাজন। এরমধ্য ১৭৫৭ পরাধীনতার, ১৯৪৭ ভঙ্গস্বপ্নের, ১৯৫২ ভাষা অধিকারের, ১৯৬৯ স্বাধিকার সংগ্রামের আর ১৯৭১ ভূখণ্ড ও পতাকা অর্জনের। সব কালপঞ্জিই একই চেতনাসূত্রে গ্রথিত হলেও ১৯৫২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ খুবই নিবিড় যুথবদ্ধ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও মুক্তির লড়াই। এই কালবিভাজনেই জড়িয়ে আছে বাঙালীর স্বাধিকার অর্জনের, ভাষা অধিকারের, গণঅভ্যুত্থান কিংবা স্বাধীন হবার সাহসী সংগ্রাম ও মর্মন্তুদ ঘটনা।বাঙালীর মানসমূল তাই ভাষার লড়াই থেকে শুরু আর স্বাধীনতা দ্বারা স্নাত। বাঙালী এই দ্রোহ উপকরণ ও জীবনোপলব্ধির দ্বার উন্মোচন করেই তার পরাধীনতার দ্বিধামুক্তি ঘটিয়েছে। বাংলার কবি’রা এই দ্রোহের সঙ্গে মিশালেন জাতিক-আন্তর্জাতিক দার্শনিকতা এবং তার অন্তর্ময় শিল্পের মিথষ্ক্রিয়া। ’৪৭ পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা না দেওয়া, পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ব-বাংলার মানুষের উপর ফ্যাসিবাদী আচরণ, পূর্ব-বাংলার অর্থ লুটে নিয়ে পূর্ব-বাংলাকে অর্থনৈতিক বৈষ্যমের শিকারে পরিণত করা। ফলে, বাঙালীর চিন্তা ও মনীষায় নোতুন প্রবণতা চি‎হ্নিত হলো; তার বিষয়বলী ও শব্দানুষঙ্গের মধ্যে জমা হলো; শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ স্পৃহা।

সালাম, রফিকউদ্দীন, জব্বার ’৫২-র কৃষ্ণচূড়ায় যে লাল রক্ত ঢেলেছিল, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ৭০-এর নির্বাচনের পর তা তৈরী হলো— স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে। এই শয়তান ও সন্তুর তাৎপর্যপূর্ণ লড়াইয়ে বাংলার সমগ্র-জনগোষ্ঠীর জীবন ও মনন তাই হলো বিপর্যস্ত আলোড়িত, দ্রোহ-স্পন্দনে রূপান্তরিত। ফলে, দেশের প্রতিটি প্রাণ জড়িয়ে পড়ল জীবনপণ যুদ্ধে। আর এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ দুই ভাবে— কায়াতে এবং কলমের নিবে। নয় মাসের এই নিরন্তর মৃত্যু ও রক্তপাতের মধ্যে রচিত হলো নোতুন ভূখণ্ডের কবিতা। কার্যত এইসময় থেকে দুঃস্বপ্নের কাব্য-উচ্চারণ যখন ঘটছিল— বৃহৎ বাংলার অন্য ভূখণ্ড অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, ঈশান বাঙলা ও বরাক উপত্যকার বাঙালীদের কবিতা থেকে— বিষয় ও প্রকরণে, জীবনঘনিষ্ঠতায়, বাস্তবতার সংঘাতে, আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো কথামালায় মধ্যদিয়ে আলাদা উঠল। বাংলা কবিতার কালীক পৃষ্ঠায় লেখা হলো পূর্ববাংলার মানুষের জীবনের দ্রোহ-রক্ত, অশ্রু আর মহত্তম সংগ্রামের দলিল।

জীবন, দ্রোহ যখন এক মেরুতে এসে দাঁড়ায় তখন শিল্পের মুগ্ধ আড়াল অন্তর্হিত হয়, কবিতায় ছায়াফেলে আবেগ, মুক্তি আকাঙ্ক্ষা, সৃজন হারানো বেদনা ও স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ। ফলে, কবিতা অনেকখানি সরে আসে শ্লোগানের কাছে আর কবি দাঁড়িয়ে যান মিছিলে, বন্দুক-বেয়োনেট হাতে যুদ্ধের ময়দানে। ডিনামাইট, বুলেটে ছিন্নভিন্ন কবি’রাও টেঞ্চে বসে অনেক কবিতার জন্ম দিলেন, লিখলেন নিজের আর সহযোদ্ধাদের মর্মন্তুদ ঘটনার বিবরণ। সঙ্গত কারণের এই কবিতায় গায়ে লেগে গেল রক্ত আর কাদা, বর্ণমালায় মিশে গেলে জীবন সংগ্রাম ও মৃত্যুর ধূপগন্ধ।

মূলতঃ ষাট দশকে যে দীপ্ত মিছিল ঢুকেছিল বাংলা কবিতায়, তা ’৭১-রে এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে মাঠে-ময়দানে, ঢাকাসহ পূর্ব-বাংলার জনপদে। সঙ্গত কারণে এই সময়ের কবিতায় উঠে আসে মৃত্যু, রক্তপাত, ধর্ষণ, ছিন্নভিন্ন লাশের আর্তি। এভাবেই পূর্ব-বাংলা কবিতা স্পর্ধা দেখানো, শ্লোগান কালোত্তীর্ণ হয়ে মহাকালের কবিতা হয়ে উঠল। এই সময়ে লেখা কবি আজীজুল হকের গান—

সাবধান সাবধান সাবধান

বাংলার শত্রুরা সাবাধান।

পূর্ব-বাংলার কবিতায় এভাবেই বড় হয়ে উঠল সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ উন্মুখ বাঙালীর স্বাধিকারের চি‎হ্ন। দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসায়তা প্রথম প্রমাণ হলো ভাষা আন্দোলনের মাধ্যামে।

প্রথম জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ১৯৫৮ সালে জারি করা হলো সামরিক আইন। স্বৈরাচারী আইউবি শাসনের সূচনা লগ্নেই বাংলাদেশের মানুষ বিদ্রোহে ফুসে ওঠে। আইউব খান দমন-নিপীড়নের পাশাপাশি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মৌলিক গণতন্ত্রের শাসন গ্রামশাসনকেন্দ্রিক এক ধরনের অনুগত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সহায়তায় পাকাপোক্ত হয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সুবিধাবাদী অবস্থান ও টানাপোড়েনকেও নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আইয়ুব শাহী। এই সময়ে, ১৯৬২-তে শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ হলে ছাত্র-সমাজ বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। মওলানা ভাষানীর ‘এ আজাদী ধূকা হ্যায়, লাখো বাঙালী ভূখা হ্যায়’ এই শ্লোগান তোলেন; আর পাকিস্তান নয় শুরু হয় নবতর জাতীয়তাবাদী চেতনাও স্বাধিকার আন্দোলন। ছাত্র বিক্ষোভে বন্ধ হয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন। কিন্তু বাঙালী তখনও জেগে উঠতে পারি নি কেননা তখনও পূর্ব-বাংলায় রাজনীতির ভেতর থেকেছে লেজুরবৃত্তি, আপোষকামিতা— ফলে বাঙালী-জাতি থেকে যায় অদূরদর্শী ও বহুধাবিভক্ত।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ডামাডোলকে পাকিস্তানী শাসকরা অখণ্ড পাকিস্তানী চেতনা, মুসলমান ভাই ভাই ইত্যাদি শ্লোগান তুলে— বাঙালীর উদ্দীপনাকে, জাতায়তাবাদী চেতনাকে কিছু সময়ের জন্য নৈরাশ্যে নিপাতিত করে। এইসব তৎপরতাহীনতার মধ্যেই মধ্যবিত্ত বাঙালী প্রত্যক্ষ করে বাঙালীর নেতৃত্বহীনতা, আত্মবিক্রীত বুদ্ধিজীবীদের বৈপরীত্যময় ভূমিকা। যার প্রভাব বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুরু হয় গণ-অসন্তোষ। এ সময়ই বাঙালী প্রথম উপলব্ধি করে বৈষম্যমূলক পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থার অসারতা এবং আত্ম-অস্তিত্বের সঙ্কট। এই বোধ থেকেই পাকিস্তানী বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালীরা, অরক্ষিত হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের একচোখা নীতি ও পক্ষপাতিত্বমূলক শাসন পূর্ব-বাংলার জনপদের কাছে দুর্ভাগ্যের পরিহাস হয়ে ওঠে। এই সময়ে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে সালাম জানানোর মধ্যদিয়ে পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে, বাংলাদেশকে স্বাধীনতার মন্ত্রে জাগিয়ে তোলেন, তারপর বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালীর স্বাধীন চিন্তাকে জাগ্রতও সংগঠিত করে তোলে।

মূলত ১৯৬৬ সালের স্বায়ত্বশাসনের দাবী বাংলার মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। মওলানা ভাসানী ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’ এই শ্লোগান তুলে এই আন্দোলন তীব্রতর করে তোলেন ১৯৬৭-তেই। শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিব এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়। বাঙালীর উপর এই মামলা স্বৈরাচারের নিপীড়নের নোতুন কৌশল এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের দমননীতি হিসাবে দেখে। ফলে, দানাবেধে ওঠে বাঙালীর ঐক্যবদ্ধ জাতীয়বাদী সংগ্রাম।

১৯৬৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘জুলম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। পরদিন ডাকা হয় হরতাল। এই হরতালে নির্বিচারে চলে গুলি, তিনজনের মৃত্যু হয়। জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে, শুরু হয় গণআন্দোলন। সরকারি আইন অমান্যকরণ, সান্ধ্য আইন অমান্যকরণ, হরতাল, সরকারি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ নানাবিধ বিক্ষোভ কর্মসূচি বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের গতিকে বেগবান করে তোলে। এই বিক্ষোভের মুখে ১৯৬৯-এর ২৫শে মার্চ আইউব খান পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালীর গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করতে আবারো সামরিক আইন জারী করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালীর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র আবাসভূমির মন্ত্রধ্বনি। এই স্বতন্ত্র আবাসভূমি ও স্বাধীন পতাকা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল ১৯৬৯-৭১। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকার তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। ইয়াহিয়ার এই অভিসন্ধি আগুনে ঘি ঢালার মত বাঙালীর চেতনায় নোতুন অভিঘাত সৃষ্টি করে। ফলে বাঙালীর স্বায়ত্তশাসনের দাবী রূপান্তরিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯৭১ সালের ২ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং ৭ই মার্চ-এর ভাষণে শেখ মুজিব স্বাধীনতার দাবীকে অনিবার্য করে তোলেন। তারপর ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র ও পঁচিশে মার্চের নির্মম গণহত্যার প্রতিশোধে দীপ্তমান পূর্ববাংলার ৭ কোটি বাঙালীর দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম রক্তস্নাত লাল সবুজ পতাকার স্বাধীনতা এনে দেয়।

এই রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু পূর্ববাংলার কবিদের আলোড়িত করেনি— এর সঙ্গে যুক্ত হয় পূর্ববাংলার অর্থনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতি। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সংস্কৃতিক আগ্রাসন ছিল স্বৈরাচারী পাকিস্তানীদের অন্যতম ষড়যন্ত্রের অংশ। পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকারে পরিণত হয়, ফলে তাদের জীবনযাত্রা গড়ে ওঠে শোষণ ও শোষিতের টানাপোড়েনে। বাজেটের মাত্র ৩৪ শতাংশ ব্যবহার করা হয় পূর্বপাকিস্তানের জন্য আর বৈদেশিক ঋণের ১৮ শতাংশ। এছাড়া ১৯৫৫-৬১ এবং ১৯৬০-৬৫ এই দু’টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও পূর্বপাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়।

অর্থনীতির মত সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই গভীর ষড়যন্ত্র এবং অলজ্জ পক্ষপাত অব্যাহত ছিল। ১৯৪৭ থেকেই পাকিস্তানী জোশ আমদানী করে বাঙালীকে সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিছিন্ন করা পশ্চিমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্র সাহিত্য বিরোধিতার প্রসঙ্গটিও। সেক্ষেত্রে সংস্কৃতির প্রধান ধারক ভাষা হলো আক্রান্ত। রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রচলন এবং জাতীয় ভাষা সৃষ্টির উদ্যোগ— সেই গভীর ষড়যন্ত্রকে চি‎হ্নিত করে তোলে। এভাবে বাঙালী জাতিসত্তার উপর চলে নগ্ন হস্তক্ষেপ। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের রবীন্দ্র বিরোধী মন্তব্যে আবার রবীন্দ্র বিতর্কের শুরু হয়। এরই প্রতিবাদ হিশাবে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ’। সম্মিলিত বাঙালীর প্রতিবাদ এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাফল্য দেশের মুক্তচিন্তার মানুষ ও বুদ্ধিজীবী মহলে প্রেরণার প্রাণাবেগ তৈরী করে। এরই পরবর্তীফল হয় সুদূরপ্রসারী— যা রূপান্তর করে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে।

ষাটের দশক থেকে এই অভিঘাত, রাজনীতি, সংগ্রাম, দ্রোহ পূর্ববাংলার রাজনীতিকে, সংস্কৃতিকে এবং সমাজকে আন্দোলিত করেছে। ফলে, পূর্ববাংলার কবি’র আত্মা এই অহম্ ও দর্প দ্বারা চূর্ণ, এই সাহস ও শ্লোগান দ্বারা উজ্জীবিত, এই অহংকার ও শপথমালার গানে মুখরিত।

পূর্ববাংলার কবি’রা, লেখক বুদ্বিজীবীরা এই উত্থান পতনের অলজ্জ বাস্তবতা ও অস্তিত্ব সংকটের শেকড়ের মধ্যে খুঁজেছে তাদের ভাষার বর্ণমালা, অনুভূতির বাংকার। ফলে, এই মূলবোধতাড়িত, শ্লোগান, অভিযাত, সংঘর্ষ, দ্রোহ দ্বারা নদীতীরবর্তী এই বদ্ধীপের কবি’রা শিল্পসিদ্ধির বর্ণমালা, চেতনার ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে। যা অনেকটা শিল্প অভিঘাতহীন কিন্তু জীবন ঘনিষ্ঠ, যা অনেকটা নিস্তরঙ্গ, শ্লোগানময়, উচ্চকিত এবং এই একই বিষয় নিয়ে— কিন্তু তা বেদনার ভাষা, রক্তাক্ত হবার ভাষা, যার অনেকগুলি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে অর্থাৎ ট্রেঞ্চে বসে লেখা কবিতা কিন্তু তা জীবনবর্জিত শিল্পকল্পনা দ্বারা স্নাত নয়। এইসব বিষয় ও প্রকরণ প্রপঞ্চ বাংলাদেশের কবিতাকে আলাদা করে তুলেছে তাবৎ বাংলা ভাষাভাষী কবিতা থেকে। ৫২, ৬৯, ৭১ এই আলাদা হবার কালীক সিঁড়ি। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগে যে রক্তাক্ত ছেদচি‎হ্ন রচিত হয়েছিল। মোটা দাগে ৫২, ৬৯, ৭১ সেই ছেদচিহ্নকে ধারণ করেই ভাষা, বর্ণ, অস্তিত্বের দ্রোহ উচ্চারণে, শ্লোগানে নোতুন চরিত্র রূপ নিল। ১৯৪৭-এর ছেদচি‎হ্নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিশাবে ৪৮শেই যশোরের মণিরামপুরে ভাষার জন্য আয়োজিত প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে আলমগীর সিদ্দিকী প্রমাণ করলেন, এ বিভাজন অসার, বিভাজিত। এই ভাষার দাবী থেকেই বৃহত্তর জাতিসত্তার বিস্ফোরণোম্মুখ অবস্থা পূর্ববাংলার মানুষকে শেখালো মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াবার স্পর্ধা। এই স্পর্ধা ধারণ করেই পূর্ববাংলার কবিতায় পরিত্যক্ত হলো শিল্প নিরীক্ষা ও শব্দ প্রপঞ্চের অধিকাংশ মন্ত্রধ্বনি। তার বদলে রক্তক্ষরণ ও সন্ত্রাস অভিক্ষেপক ও শ্লোগানচারিতার দিকে ধাবিত হলো। এই দ্রোহ প্রপঞ্চই শিল্পচৈতন্য হয়ে উঠল, গান হয়ে উঠল; এখন তা দাঁড়ালো পতাকা হয়ে— জীবন ও জীবনের দাবীর সপক্ষে।

এই সময়, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে স্বৈরাচারী পাকিস্তানী সরকার যেমন নোতুন নোতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, বাঙালী তেমনি সশন্ত্র প্রতিবাদ আর সাংস্কৃতিক মুভমেন্ট গড়ে তুলেছে। কিন্তু তখনও রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠ পূর্ববাংলা বুকে ধরে আছে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা ভাষা।

তৎকালীন বাংলা একাডেমী ভাষা-সংস্কার কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে কতিপয় বর্ণবর্জনসহ কিছু সুপারিশ পেশ করে— বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই নগ্ন হস্তক্ষেপে সোচ্চার হয়ে ওঠেন, ফলে পাকিস্তানীপন্থীদের এই ষড়যন্ত্র কার্যকরী হয়ে ওঠেনি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ঘিরে দ্বিধা-সংশয়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে কাজী নজরুল ইসলামকে সামনে এনে বিতর্কের সূত্রপাত করা হয়। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখা হয়—

সোজা কথায়, রবীন্দ্রনাথের দোহাই তুলিয়া অখণ্ড বাংলার আড়ালে আমাদের তামদ্দুনিক জীবনের বিপদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেওয়া চলিবে না। একদল লোক পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের অন্ধ অনুসারী ও ভক্ত। তাহাদের রবীন্দ্রভক্তি বিপদের কারণ হইতে পারে। এবং বাইরের যারা পাকিস্তানকে দ্বিধাহীন মনে গ্রহণ করে নাই, তাহারা এই সুযোগে তামদ্দুনিক অনুপ্রবেশের খেলার নামিতে পারে।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের রবীন্দ্র বিরোধী মন্তব্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রবীন্দ্র বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত অর্থাৎ কালপঞ্জি; ষাটের উত্তাল ঘটনাতরঙ্গ পূর্ববাংলার কবিদের মাথার খুলিতে পুতে দেয় অস্তিত্বের চারাগাছ।

তারই সুদূরতম বিধিলিপি রক্তশিরায় বহন করে চলেছে বাংলাদেশের কবিতা। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা শুধু স্মৃতির বর্ণমালা নয়, তা বাঙালী রক্ত ধারায় প্রবাহিত দ্রোহ ও চেতনার স্পন্দন। যা মুক্তি-আকাঙ্ক্ষার দেশ প্রেম, স্বজন হারানো বেদনা, স্বপ্নভবিষ্যৎ অনুসন্ধান এবং চিরকালীন আবেগ ও উদ্ভাসন। সে সূত্র ধরেই সিকান্দার আবু জাফর এর উচ্চারণ—

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে

বাঁচবার অধিকার কাড়তে

দাস্যের নির্মোক ছাড়তে

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ

চলবেই চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

প্রতারণা প্রলোভন প্রলেপে

হক না আঁধার নিশ্ছিদ্র

আমরা তো সময়ের সারথী

নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র

দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরও দেবো অস্থি

প্রয়োজন হলে দেবো এক নদী রক্ত।

[সংগ্রাম চলবেই, “সিকান্দার আবু জাফর”]

সিকান্দার আবু জাফরের এই ঘোষণার মধ্যে লুক্কায়িত বাঙালীর সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। যে সংগ্রাম ছিল জনতার, সে সংগ্রাম ছিল আমাদের যে সংগ্রাম ছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাণপণযুদ্ধের। সেই সংগ্রামের জন্য কবি বিলিয়ে দিতে চান তার সম্ভম আর অস্তিত্ব এবং প্রয়োজনে এক নদী রক্ত। এই কমিটমেন্ট ও দ্রোহ সেই কালের কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। যা রচিত হয়ে চলছিল মুক্তিযোদ্ধার বন্দুকের নলার মতো শব্দ যোদ্ধার কলমের নিব থেকে। ফলে এই শব্দাবলী, বাকচিত্র ও ঘটনা কবিতার লুব্ধ আড়ালকে করে তুলল মিছিলের সমান বয়েসী।

কবিতা রচনা হলো ট্রেঞ্জে— মৃত্যু, রক্তপাত, ছিন্নভিন্ন লাশের দুর্গন্ধে ভরে উঠল কবিতার শরীর। এই প্রগাঢ় উচ্চারণমালায় তাই লেখা হলো প্রার্থিত স্পর্ধা। কবিদের উপায় থাকল না কাল অতিক্রমের, বরং কালের উচ্চারণমালায় তারা মালা গেঁথে চললেন। এই মালা গাঁথার স্বাধীনতার প্রথম মন্ত্রদাতা ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা কবিতায় একটা বড় মানচিত্র দখল করে আছে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’—

ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখ

দুপুরবেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?

বরকতের রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে

জ্বলবে, এমন লাল যে,

সেই লোহিতেই লাল হয়েছে

কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!

[একুশের কবিতা, “আল মাহমুদ”]

এই সময়ের সর্বব্যাপী বিষাদ ও স্বীকারোক্তি প্রবণ কবিতার অন্যতম মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি—

যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে হত্যা করেছে

যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্থ

মাতৃসম্বোধন কেড়ে নিতে গিয়ে

আমার এই সব ভাই বোনদের হত্যা করেছে

আমি তাই ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি।

[কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি, “মাহবুব-উল আলম চৌধুরী”]

এই সময়ের কাব্যপাঠ থেকে ধারণা করা যায়— পূর্ববাংলার কবিতায় উচ্চকণ্ঠ, শ্লোগান, সংগ্রামী মনোভাব, ব্যক্তিগত দুঃখবোধ এ-রকম দ্রোহী এবং স্বৈরাচারের কাছে নিষিদ্ধ বিষয়গুলি ঢুকে পড়তে থাকে। কবিতাগুলি ভিন্নভিন্ন কবি’র হলেও জাসিত্তার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চাইল তখন। কেননা, সকল কবি’র চেতনাবিন্দু দেশের সর্বত্রে ছড়িয়ে থাকা ভাষার জন্য অপ্রতিরোধ্য জাগরণ—

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো

এক কোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো, যে ভিৎ কখনো কোন রাজন্য

পারিনি ভাঙতে

হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার

খুরের ঝটিকা ধুলোয় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে

যারা বুনি ধান

গুণটানি আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই

[স্মৃতিস্তম্ভ, “হাসান হাফিজুর রহমান”]

সংগ্রামের শপথ আর ভাই হারানো বেদনা দ্বারা স্পৃষ্ট হয়েছেন এই সময়ের কবি’রা। পূর্ববাংলার কবিতার মর্মমূলে তাই ডুকে গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের বিসংগতি আর অস্তিবাদী বাঙালীর ভাসানো ডোঙার নৌকা। উপরে উদ্ধৃত কবিতায় মাহবুল-উল আলম চৌধুরী তাই বিষাদ স্পন্দিত ভাষায় লিখলেন ভাষাশহীদদের রক্তশপথ, আর হাসান হাফিজুর রহমান অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে চেতনায় ধারণ করলেন ভাষা স্মৃতির ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। মাতৃভাষার জন্য জীবনদানকারী পুত্রের মায়ের আকুতি তুলে ধরলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ‘কোন এক মাকে’ কবিতায় তাই শব ব্যবচ্ছেদকারী শুকুনের নখরে মায়ের বুক ঝাঝরা করে দিয়ে অন্ধকারজয়ী দুঃখ-জাগানিয়া গান হয়ে উঠল আমাদের কাছে—

কুমড়ো ফুল

শুকিয়ে গেছে,

ঝরে পড়েছে ডাঁটা;

পুঁইলতাটা নেতানো—

‘খোকা এলি?’—

ঝাপসা চোখে মা তাকায়

উঠোনে, উঠোনে

যেখানে খোকার শব

শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।

[কোন এক মাকে, “আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ”]

পূর্ববাংলার কবি’রা এভাবেই একুশকেই প্রথম কবিতার সোপান করে নেয়। ’৫২-তে খুলে যাওয়া তাদের এই স্বনির্মিত মনোভূমির আকাশে— শব, অন্ধকার, পচন আর কুৎসিতকে জয় করে আত্মজাগরণের মন্ত্রে অনিবার্য ভবিষ্যৎ খুঁজে পাবার ভাষা তৈরী করে। বাঙালীর বক্ষে বর্শার ফলার মতো গেঁথে যায় ‘আমার ভায়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’ এই ধ্বনিপুঞ্জনমালা। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে যাওয়া এই উচ্চারণ কবিতায় উঠে আসে—

আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে-ওঠা

বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো তাঁকে ডেকো না;

আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুচকে উঠবে—

সালাম, রফিকউদ্দীন, জব্বার— কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;

এই এক সারি নাম তার বর্শার তীক্ষ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে; ...

...

যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদের বিস্তৃত করে দিয়ে গেল

দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল

[অমর একুশে, “হাসান হাফিজুর রহমান”]

এই ভাষার অনুষঙ্গ ও অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়েই ৬৯ হাজির হলো স্বাধিকারের লড়াইয়ে—

ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !

শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে

দুয়োর বেঁধে রাখ।

কেন বাঁধবো দোর জানালা

তুলবো কেন খিল ?

আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে

ফিরবে সে মিছিল।

ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !

ট্রাকের মুখে আগুন দিতে

মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিয়ুরকে

ঘুমিয়ে আছে সে!

তোরাই তবে সোনামাণিক

আগুন জ্বেলে দে।

[ঊনসত্তরের ছড়া-১, “আল মাহমুদ”]

অথবা—

কারফিউ রে কারফিউ

আগল খোলে কে ?

সোনার বরণ ছেলেরা দেখ্

নিশান তুলেছে।

লাল মোরগের পাখার ঝাপট

লাগলো খোঁয়াড়ে

উটকোমুখো সাস্ত্রী বেটা

হাঁটছে দুয়ারে।

খড়খড়িটা ফাঁক করে দে

বিড়াল-ডাকে ‘মিউ’,

খোকন সোনার ভেংচি খেয়ে

পালালো কারফিউ।

[ঊনসত্তরের ছড়া-২, “আল মাহমুদ”]

ভাষা অধিকারের দ্রোহ তাই নিয়ে গেল স্বপ্নের রৌদ্রে, অস্তিত্ব-ক্ষুধা থেকে জন্ম নিল স্বাধীন পতাকা আর ভূখণ্ডের স্বপ্ন। ভাষার, ধ্বনির এই নিরন্তর দ্রোহীপদযাত্রা তাই পূর্ববাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে প্রাণের আবেগ আর হার্দ্য টান হয়ে জ্বালিয়ে দিল ঘরে ঘরে চেতনার বাতিঘর—

তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল

রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ, উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে

তীরের ফলার মতো

নিক্ষিপ্ত ভাষার চীৎকার;

বাঙলা বাঙলা

কে নিদ্রামগ্ন আমার মায়ের নাম উচ্চারণ করো?

[নিদ্রিত মায়ের নাম, “আল মাহমুদ”]

(চলবে)

১৪ই ভাদ্র ১৪২০

লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ