দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ধাপে বন্ধ থাকার পর আবারও খুলল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে মঙ্গলবার প্রথম ধাপে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২ মার্চ খুলবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো।

২০২২ শিক্ষাবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে টানা এক মাস শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার বাইরে থাকল প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত সাড়ে চার কোটি ছাত্রছাত্রী। এক মাস এক দিন পর মঙ্গলবার শিক্ষায়তনের আঙিনায় পা পড়ছে তাদের। তবে প্রাথমিকের খুদে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে আরও সাত দিন।

ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার থেকেই ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। সরকারি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কাল-পরশুর মধ্যে ক্লাস শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে করোনার বিধিনিষেধ মঙ্গলবার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস শুরু হচ্ছে পুরোদমে।

গত দুই বছরে দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি (লার্নিং লস) পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত ক্লাস চালুর পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। প্রয়োজনে ছুটির দিনগুলোতেও ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তাদের।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, টানা ছুটির কারণে এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের যে শিখন-ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সাধারণ রুটিনের অতিরিক্ত দু-একটি ক্লাস নিতে পারেন শিক্ষকরা। প্রয়োজনে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চালিয়ে যেতে পারেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ থেকে সদ্য পাস করা তরুণ-তরুণী যারা এ মুহূর্তে বসে আছেন, কিছু সম্মানীর বিনিময়ে তাদেরকে দিয়েও এই অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়।

ইউনেস্কোর তথ্যমতে, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রায় ৮২ সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণ এবং আংশিকভাবে বন্ধ রয়েছে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম। করোনার বিস্তারকালে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশ তাদের স্কুল পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল, ১০টি দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে বন্ধ এবং আরও ১০টি দেশ স্কুল খোলা রেখেছিল। কুয়েত ৬২ সপ্তাহ, ভেনেজুয়েলা ৬১ সপ্তাহ, উগান্ডা এবং ফিলিপাইন ৬০ সপ্তাহ, মিয়ানমার ৫৯ সপ্তাহ এবং হন্ডুরাস ৫৮ সপ্তাহ বন্ধ রেখেছিল।

জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী ভারত ২৫ সপ্তাহের জন্য তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছিল এবং পাকিস্তান ৩৭ সপ্তাহের জন্য বন্ধ করেছিল। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইডেন কখনোই পুরোপুরি স্কুল বন্ধ করেনি। এমনকি ব্রাজিল, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে যেখানে সর্বোচ্চ মৃত্যুর হার, সেখানেও মাত্র ৩৮ সপ্তাহ সম্পূর্ণ স্কুল বন্ধ ছিল। ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার শুরু থেকে স্কুল বন্ধের কারণে বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে। তৈরি হয়েছে ব্যাপক শিখন-ঘাটতি।

এদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও শিক্ষার্থীদের সশরীরে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ রয়েছে। প্রতিষ্ঠান খোলার পর কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ২০টি নির্দেশনা দিয়ে একটি আদেশ জারি করেছেন।

নির্দেশনায় যা বলা হয়েছে-

১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে শিক্ষার্থীরা কোডিড-১৯ টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে, তারা সশরীরে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে।

২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখসহ অন্যান্য স্থানে কোভিড-১৯ অতিমারি সম্পর্কিত সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে করণীয় বিষয়সমূহ ব্যানার বা অন্য কোনো উপায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা ও তা পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করা।

৪. পরিস্থিতি বিবেচনায় অনলাইন/ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিখন-শেখানো কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।

৫. শিক্ষার্থীদের জন্য বিতরণকৃত অ্যাসাইনমেন্টসমূহের কার্যক্রম যথারীতি অব্যাহত থাকবে।

৬. শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুটিন ইতোপূর্বে প্রেরিত নির্দেশনা মোতাবেক প্রণয়ন করতে হবে।

৭. শিক্ষার্থীদের ভিড় এড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের সবগুলো প্রবেশ/প্রস্থান মুখ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা। যদি কেবল একটি প্রবেশ/প্রস্থান মুখ থাকে সেক্ষেত্রে একাধিক প্রবেশ/প্রস্থান মুখের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা।

৮. প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শ্রেণি কার্যক্রমে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করা।

৯. প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করবে এবং বাসা থেকে যাওয়া আসা করবে, সে বিষয়ে তাদের শিক্ষনীয় ও উদ্বুদ্ধকারী ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করা।

১০. প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ আইসোলেশন কক্ষ হিসেবে প্রস্তুত রাখা।

১১. প্রতিষ্ঠানের সব ভবনের কক্ষ, বারান্দা, সিঁড়ি, ছাদ ও আঙিনা যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করা।

১২. প্রতিষ্ঠানের সব ওয়াশরুম নিয়মিত সঠিকভাবে পরিষ্কার রাখা এবং পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখা।

১৩. প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী, অভিভাবকসহ অন্য কেউ প্রবেশ/অবস্থান/প্রস্থানের সময় সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা।

১৪. প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারী এবং অন্যদের সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান করার বিষয়টি নিশ্চিত করা।

১৫. প্রতিষ্ঠানে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা।

১৬. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে পারস্পরিক তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করা।

১৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ, ড্রেন ও বাগান যথাযথভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং কোথাও পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা।

১৮. প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা নিরূপণ করা।

১৯. প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা।

২০. প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকদের সঙ্গে সভা করে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)