বিজিবি'র টহল : আতঙ্ক নয়, বিস্মিত কুমিল্লার মানুষ
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত মানুষ। রিকশা, ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে আপন গতিতে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষগুলোও যে যার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দেখে বিস্মিত মানুষ। অনেকের মনে প্রশ্ন, কেন তারা টহল দিচ্ছেন?
কুমিল্লা নগরীতে বিজিবির টহল দলের আনাগোনার কারণ একটাই, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে সে কারণে এক মাস আগেই বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই গতকাল থেকে টহলে নেমেছে বিজিবি। তারা এখন শহরের আনাচকানাচ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিজিবি টহল দেবে। যাতে শহরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
কুমিল্লার রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী জানান, তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রার্থীদের আচরণবিধি দেখার জন্য ইতিমধ্যে মাঠে আছেন। গতকাল রোববার থেকে এক প্লাটুন বিজিবিকেও মাঠে থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা বলেন, নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা জোরদার করা উচিত, সেটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এক মাস আগে বিজিবি মোতায়েনের মতো কোনো পরিস্থিতি কুমিল্লায় তৈরি হয়নি। এটাকে অনেকে নির্বাচন কমিশনের বাড়াবাড়িও বলছেন।
গতকাল দুপুরে কান্দিরপাড় কুমিল্লা সিটি মার্কেটের সামনে দোকানি মুসা বলেন, শহরের অবস্থা অনেক ভালো। কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। নির্বাচনের আগে এমন কোনো পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কাও নেই। তবু সরকার কেন বিজিবি মোতায়েন করল, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
কলেজশিক্ষার্থী শাহেদ বলেন, ‘বিজিবি দেখে প্রথমে মনে হয়েছে কোনো মিশনে এসেছে তারা। পরে মানুষের কাছে শুনতে পারলাম, নির্বাচনের জন্যই সরকার আগাম বিজিবি মোতায়েন করেছে।’
রিটার্নিং কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনো কোনো প্রার্থী নিয়ম না মেনেই নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করছেন। এ জন্য অভিযোগ পাওয়ামাত্রই তাঁর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘এখনই প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শুরু করার কথা নয়। কিন্তু যারা প্রচারণার প্রয়াস চালাচ্ছেন, আমরা তাঁদের শোকজ করছি এবং মৌখিকভাবে সতর্ক করছি।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ১০৫টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। যার মধ্যে ৬৪০টি ভোটকক্ষ থাকবে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুসারে, নির্বাচনে ১৮৯ জন প্রার্থী তাঁদের নির্বাচনী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এতে ৫ জন মেয়র পদপ্রার্থী, ১৪৭ জন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী এবং ৩৭ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। যাঁরা মনোনয়নপত্র নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১২ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ তালিকায় একজন সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী, ৮ জন সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী এবং ৩ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন।
এদিকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীদের মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন করে হিসাব-নিকাশ। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত অন্য প্রার্থীরা নৌকার পক্ষে কাজ করার কথা জানালেও বিএনপি-সমর্থক স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর মধ্যে রয়েছে প্রকাশ্যে বিরোধ।
জানা যায়, ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রবীণ নেতা আফজল খানকে পরাজিত করে মেয়র হন বিএনপি-সমর্থিত মনিরুল হক সাক্কু। ২০১৭ সালে আফজল খানের মেয়ে আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার মেয়র হন সাক্কু। তখন অভিযোগ ছিল, গ্রুপিংয়ের কারণে গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা হেরেছেন।
এবার সিটি নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা-৬ সদর আসনের সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার তাঁর অনুসারী আরফানুল হক রিফাতকে নিয়ে মনোনয়ন যুদ্ধে নেমেছেন। নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে একক প্রার্থী করে কেন্দ্র থেকে নৌকার মাঝি বানিয়ে আনেন।
এদিকে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া ১৩ জনের অধিকাংশ নেতাই সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ সময় কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে বিএনপির দুই গ্রুপের দুই প্রার্থী নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। একপক্ষ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু ও অপর প্রার্থী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের অনুসারী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার।
জানতে চাইলে নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, ‘বিএনপি নামধারী কিছু আওয়ামী লীগ নেতার নির্যাতনে দলের নেতা-কর্মীরা অতিষ্ঠ। তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মীদের চাপে আমি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। নগরীর তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মীদের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে আমাকে পরাজিত করতে মেয়র সাক্কু আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী হয়েছেন। দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মী আমার সঙ্গে আছে।’
মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘আমি একবার পৌর চেয়ারম্যান ও দুবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলাম। সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করেছি। দলের নেতা-কর্মী ও নগরবাসী আমার সঙ্গে আছে। আমার আরও কিছু কাজ অসমাপ্ত রয়েছে আর সেগুলো সমাপ্ত করতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।’
নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত বলেন, ‘নেত্রী আমার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন। আমি সিটি মেয়র পদটি নেত্রীকে উপহার দেব। মহানগরের ২৭টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো সুসংগঠিত। সব নেতা-কর্মীকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করব।’
বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘এবার তৃণমূল আওয়ামী লীগের মনোনীত একজন যোগ্য, ত্যাগী ও পরীক্ষিত সাংগঠনিক কর্মী ও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ও নৌকার প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কুসিক নির্বাচনে মেয়রের বিজয় ছিনিয়ে আনব।’
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ১৬ মে, ২০২২)