ওয়াকিলুর রহমানের নিয়মনের শিল্পভাষা
রেজাউর রহমান
সংযম শব্দটি কানে এলেই যেন নিয়মতান্ত্রিক জীবনের কথা মনে হয়। নিজেকে সংযত রেখে সংহত করা, তবে তা পার্থিব জগতের বাইরে গিয়ে নয়, এই প্রকৃতির অধীনস্থ হয়েই সংযমে অন্তঃস্থ হওয়া। সংযম ধর্মগোত্রীয় শব্দ হলেও তার ব্যবহার নানাভাবে জীবনে আসতে পারে। ইসলামি সুফিবাদ থেকে বাউলতত্ত্ব তালাশ করলে এই সংযমের বিষয়টি আসে ভিন্নভাবে। তবে আত্মাকে কষ্ট দিয়ে নয়, পূর্ণ শান্তির আশায় সংহত হওয়া, এমনই সংযমের পথের পাথেয় তৈরি করেছেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান।
গত ২৪ এপ্রিল থেকে ঢাকায় কলাকেন্দ্রে শুরু হয়েছে ওয়াকিলুর রহমানের চিত্রকলা প্রদর্শনী। শেষ হবে ২৪ মে। প্রতিদিন শিল্পরসিকজন হাজির হচ্ছেন প্রদর্শীতে।
আসলে শিল্পী নিজেকে গেরুয়া কোন পোশাক বা সুফিদের মতন সাদা কাপড়ে নিজেকে আবৃত করেন নি, তিনি সংযমে লিপ্ত, ক্যানভাসে-রেখায়-বর্ণে-কাগজে শিল্পভাষাকে নতুনভাবে ব্যক্ত করতে সদা তৎপর। কয়েক দশকের শিল্পচর্চায় তিনি নানাভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
হয়েছেন শিল্পের তীর্থযাত্রী, অ্যাকাডেমিকধারাকে নানাভাবে উপস্থাপন করা থেকে শুরু করে তা বর্জনও কীভাবে করতে হয়, তা দেখিয়েছেন।সময় যত গড়ায় বক্তব্য তত সংক্ষিপ্ত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন "যেখানে সাহিত্যের শেষ সেখানে চিত্রকলার শুরু।"
দৃশ্যকলার বিশালত্বকে সংকোচন করতে হয় তার প্রকাশের মাধ্যমে। সহজকথা সহজ করে বলাটা কঠিন। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান দীর্ঘ পথ হেঁটে এই সত্যটি পরিমিতমাত্রায় প্রকাশ করেছেন সংযম শিরোনামে চিত্র প্রদর্শনীর মধ্যদিয়ে। গ্যালারী কলা কেন্দ্রের দেওয়ালে শিল্পের সংযম কীভাবে হতে পারে, কি ফর্মে- রেখায়-বর্ণের তা পরতে পরতে দেখিয়েছেন। সকলদিক থেকে সংযত তিনি, শুধু কি শিল্পে? তা মনে হয় না। বলা হয়, একজন শিল্পীর জীবনপ্রণালী তার শিল্পের সাথে সহাবস্থান প্রক্রিয়া নির্ণয় করে।
শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান মূর্ত-বিমূর্ত সকল বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে সংযত হচ্ছেন শিল্পের ভাষায়। সংযম তিনি ভাঙলেন কলা কেন্দ্রে, তবে শিল্পের সংযম ভাঙাটা অতটা সহজ বা সময় বেঁধে দিয়ে হয় না। আত্মচিত্তের ইন্দ্রিয়ইঙ্গিত এই সংযম ভেঙে দিতে পারে। ওয়াকিলুর রহমান চিন্তায় বা শিল্পের উপকরণ নিয়ে সংযম করেন বলে মনে হয় না, বক্তব্যে সংযত তিনি, স্পেস ব্যবহারে, রেখা টানতে, কোলাজ ও সংক্ষিপ্ত বর্ণের ব্যবহারে তিনি সংযমে পরিপূর্ণ। সাদা-কালোকে বেছে নিয়েছেন কিন্তু আত্নাকে পুলকিত রেখেছেন সংক্ষিপ্ত রঙের ব্যবহারে।
গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস যিনি সিনিসিজমের জনক এবং মিনিমালিজম এর বক্তব্য পেশ করেছেন কয়েক শতাব্দী আগেই, ফলে হাল জীবনের চর্চিত মেদহীন শিল্প কতটা প্রাসঙ্গিক তা দেখার বিষয়। ষাটের দশকে মার্কিন মুলুকে চর্চিত শিল্পকে বর্জন ও পরবর্তীতে বিদ্রোহী হয়ে উঠে মিনিমালিজমের পথে অগ্রসর হওয়া শিল্পীগণের পদাঙ্ক অনুসারী শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। এবার কলা কেন্দ্রে নিয়মনের মাধ্যমে স্ব-ভূখণ্ডের দৃশ্যকলার অবস্থান থেকে বের হয়ে তিনি নতুন কোনো আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন? নাকি শুধুই নিজেকে তুষ্ট রাখা? ঔৎসুক্য রয়ে গেছে দর্শককূলের।
প্রদর্শনী দেখে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে," No news is good news।" আমরা প্রত্যাশায় থাকলাম শিল্পী নিয়মনের শিল্পযাত্রাকে নিয়ে যাবেন আরো অনেক দূর।
(দ্যা রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ২১,২০২২)