দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: প্রায় ২০ কোটি নাগরিকের দেশ নাইজেরিয়াকে ধরা হয় আফ্রিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে। দেশটির ঋণের বোঝা এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আইএমএফের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষে দেশটির মোট রাজস্ব আয়ের ৯২ শতাংশই প্রয়োজন হবে ঋণ পরিশোধে। চার বছরের মধ্যেই দেশটির সরকারের মোট আয় ও ঋণ পরিশোধে ব্যয় দাঁড়াতে পারে সমান পর্যায়ে।

নাইজেরিয়ায় বেকারত্বের সমস্যা দিনে দিনে আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক তরুণ দেশটির শ্রমশক্তির অংশ হচ্ছে। কর্ম জুটছে না তাদের অনেকেরই। শুধু তরুণ নয়, দেশটির গোটা শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশই এখন কর্মহীন।

বেকারত্বের পাশাপাশি বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এখন মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকেই দেশটির পারফরম্যান্স খুবই খারাপ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের আশঙ্কা, শ্রীলংকার মতোই দ্রুত দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটছে নাইজেরিয়া।

কভিডসহ নানা কারণে কয়েক বছর ধরেই মন্দা ও শ্লথতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে নাইজেরিয়ার অর্থনীতি। চলতি বছরের শুরুতে এ পরিস্থিতি থেকে কিছুটা পরিত্রাণের আভাস থাকলেও ইউক্রেন যুদ্ধ দেশটির জন্য পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তুলেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলংকার সংকটেরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে নাইজেরিয়ায়। দেশটির রিজার্ভ এখন দ্রুতগতিতে কমে আসছে। নাইজেরীয় মুদ্রা নায়রার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন ঠেকাতে সম্প্রতি এর বিনিময় হার শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ক্রমবর্ধমান আমদানির সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ও দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। তবে এ উদ্যোগেও খুব একটা লাভ হয়নি। মুদ্রাবাজারে নায়রার বিনিময় হারে পতন অব্যাহত রয়েছে।

দেশটি ২০২২ সাল শুরু করেছিল তুলনামূলক শক্তিশালী রিজার্ভ নিয়ে। গত জানুয়ারির শুরুতে নাইজেরিয়ার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এরপর কিছুদিন তা নিম্নমুখী ছিল। মধ্যে দেশটির প্রধান রফতানি পণ্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছিল। এখন তা আবারো ফিরে এসেছে নিম্নমুখী ধারায়। বর্তমানে দেশটিতে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। রিজার্ভ নিয়ে দেশটির শিগগিরই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বিগ্ন করে তুলছে বিশেষজ্ঞদের।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে নাইজেরিয়ার চলমান অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ পরিণতির দিকে টেনে নিতে পারে।

দেশটির ঋণের বোঝা এখন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় তা ৫০ ট্রিলিয়ন নায়রার (১২ হাজার কোটি ডলারের বেশি) মাইলফলক ছাড়িয়েছে। এ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে গত বছর দেশটির মোট রাজস্বের ৭৬ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। এ বছর তা দাঁড়াতে পারে ৯২ শতাংশে। লাগাম টেনে ধরা না হলে শিগগিরই দেশটির রাজস্ব আয় ও ঋণ পরিশোধের ব্যয় সমান হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা আইএমএফের।

গত বছর থেকে প্রিমিয়াম মোটর স্পিরিট (পিএমএস) সাবসিডি নামে বিশেষ এক ভর্তুকি চালু রয়েছে নাইজেরিয়ায়। এর আওতায় দেশটিতে পরিবহন জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয়। এ কর্মসূচির কারণে দেশটির রাজস্ব খাতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যে উঠে এসেছে।

রাজস্ব ঘাটতি ও ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপ দেশটিকে দেউলিয়াত্বের পথে ঠেলে দিচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকা থেকে নাইজেরিয়ার নাম বাদ দিয়েছে। সংস্থাটির ভাষ্য হলো, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও এর সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি নাইজেরিয়া। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নাইজেরিয়ার অবস্থান এখন খাদের কিনারে বলে মনে করছে বিনিয়োগ ব্যাংকটি।

দেশটিতে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করাও এখন সাধারণ নাইজেরিয়ানদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশটির আবুজা শহরেও চলতি বছরের শুরুতে ১ ডলার ৪৩ সেন্টের সমান মূল্যের একটি ফ্যামিলি সাইজ বড় রুটি কিনতে পাওয়া যেত। বর্তমানে একই রুটির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ ডলার ২ সেন্টের সমান। ক্রমবর্ধমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেশটির সার্বিক মূল্যস্ফীতিকে করে তুলেছে লাগামহীন। বর্তমানে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

বর্তমানে গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিই মন্দার দিকে যাচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের এক সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক খাতসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, সেক্ষেত্রে দেশটির জন্য পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নাইজেরিয়ার সেন্টার ফর প্রমোশন অব প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ ড. মুদা ইউসুফ সম্প্রতি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়ার অর্থনীতিতে দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। নাইজেরিয়া এমনিতেই অর্থনৈতিক অনেক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিকে আরো প্রতিকূল করে তুলবে। আমরা এখন মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ সামষ্টিক অর্থনীতির অনেক বিষয়েই নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে তা আরো খারাপের দিকে যাবে। এর সঙ্গে ব্যষ্টিক পর্যায়েও অভ্যন্তরীণ অনেক সংকট রয়েছে। সে হিসাবে এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোয় শুধু অর্থনীতি নয়, বরং নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, বিনিয়োগ পরিবেশসহ আরো অনেক কিছুর ওপরই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে।

নাইজেরিয়াকে ধরা হয় আফ্রিকার অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হিসেবে। বলা হয়, দেশটির অর্থনীতিতে যেকোনো সংকট গোটা আফ্রিকার অর্থনীতিতেই তোলপাড় তুলে দিতে পারে। এরই মধ্যে মহাদেশটির বিভিন্ন দেশে তা দৃশ্যমানও হয়ে উঠেছে। ঘানা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বৃহৎ দেশগুলোর প্রায় সবই এখন মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ২ জুন, ২০২২)