শিল্পখাতে পুঁজিবাজারের অর্থায়ন কমছে, বাড়ছে ব্যাংকের
মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: পুঁজিবাদি বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে পুঁজিবাজার। শিল্প কারখানা স্থাপন বা বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য টাকা সংগ্রহের একটি বড় ক্ষেত্র পুঁজিবাজার। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে থাকেন উদ্যেক্তারা। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে চড়া সুদে ঋণ না নিয়ে তারা পুজিবাজারে শেয়ার ছেড়ে টাকা সংগ্রহ করে থাকেন তারা। কিন্ত বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো। দিনদিন এদেশে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে টাকা নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমছে শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের পরিমাণ।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্ন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক এ তথ্য পেয়েছেন। দেখা গেছে ২০১২ সালে প্রাথমিক গণ প্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করে উদ্যোক্তারা ১ হাজার ৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এ টাকা তারা শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এর পরের বছর থেকে এই প্রবণতা কমতে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ২০১৩ সালে আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কমে ৮৩২ কোটি তে নেমে আসে আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ।
তবে ২০১৪ সালেই ছিলো ব্যতিক্রম, এ বছর তা বেড়ে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায় ওঠে। ২০১৫ সালে ৩৪ শতাংশ কমে দাড়ায় ৬৮৮ কোটি টাকায়। ২০১৬ সালে আরো কমে যায় আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের পরিমাণ। এ বছর মাত্র ৫৮৪ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়। ২০১৭ সালে আইপিওর মাধ্যমে এ যাবতকালের সর্বনিম্ন টাকা সংগ্রহ হয়।এবছর মাত্র ১৬৯ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়। ২০১৮ সালে আইপিওর মাধ্যমে শিল্পখাতের জন্য মূলধন সংগ্রহের পরিমাণ ছিলো ৫৪৬ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে ৫৫২ কোটি টাকা । ২০২০ সালে কোভিড মহামারীর বছরেও ৯৫৬ কোটি টাকা ছিলো। তবে ২০২১ সালে মুলধন সংগ্রহের পরিমাণ আগের ছরের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নয় বছর আগে তথা ২০১২ সালের থেকে ২ শতাংশ কম হয়েছিলো। এবছর আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের পরিমাণ ছিলো্ ১ হাজার ১৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুত্রমতে ২০১৬ সালে ব্যাংকের মাধ্যমে শিল্পখাতে অর্থায়নের পরিমাণ ছিলো ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। একই বছর পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের পরিমাণ বা ইক্যুইটি ফাইন্যান্সিং ছিলো ৯০৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকের মাধ্যমে ৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। অপরদিকে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ১৯ কোটি টাকা শিল্পখাতে ঢুকেছে।
২০১৮ সালে ৮ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯৩ কোটি ঢুকেছে ব্যাংকের মাধ্যমে। পুঁজিবাাজরের মাধ্যমে ইক্যুইটি ফাইন্যান্সিং হয়েছে ৫৮১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যাংকের মাধ্যমে ১ লাখ ৪ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। অন্যদিকে পুজিবাজারের মাধ্যমে ইক্যুইটি অর্থায়নের পরিমাণ ৬৪০কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশন ও বাংলদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ব্যাংকের মাধ্যমে ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ শিল্পখাতে অর্থায়ন হয়েছিলো। অন্যদিকে ক্যাপিটাল মার্কেটের মাধ্যমে শিল্পখাতে টাকা ঢুকেছিলো মাত্রদশমিক ০৯ শতাংশ অর্থ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ খেলাপী হলেও ব্যবসা করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে ঋণ খেলাপীদের ছাড় দেওয়া হয়। আইপিও আসতে হলে কোম্পানির সব তথ্য পাবলিকের কাছে প্রকাশ করতে হয়। প্রতিবছর জবাবদিহি করতে হয়। তাই পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রন আর মালিকদের হাতে থাকে না। এসব কারণে অনেকে পুঁজিবাজারে আসতে চায়না। সে কারণে বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের প্রবণতা বেশী।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, আইপিওতে আসলে অনেক ধরণের জবাব দিহি করতে হয় কোম্পানিগুলোকে । তাছাড়া এতো ছোট আকারের আইপিও যে ব্যাংকের থেকে সহজেই ঋণ পাওয়া যায়। ৫০ কোটি বা ১০০ কোটি টাকার মূলধন সরবরাহ করার ক্ষমতা ব্যাংক গুলোর তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের ঋণ খেলাপী হলেও রি সিডিউল করা সুযোগ পাওয়া যায়।
ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক এই সভাপতি আরো বলেন, অন্যদেশগুলোতে কোম্পানির সুযোগ রয়েছে যে কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার। কিন্তু আমাদের দেশে দুটি স্টক এক্সঞ্জেই তালিকাভুক্তি হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দুটিতে প্রতিবছর ফি দিতে হবে।
এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হারের পার্থক্য বেশী থাকতে হবে। এবছর বাজেটে এমন সুবিধা দেওয়া হয়েছে তবে পার্থক্য কমেনি।
তালিকাভুক্ত হওয়ার আরেকটা অসুবিধা হলো বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম। আগে এজিএমে ফাইন্যান্সিয়াল রিপো্ট নিয়ে বিশ্লেষণ ধর্মী জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হতো। এখন ‘এজিএম পাস পার্টি’ নামের কয়েকটি সংগঠন চাঁদা বাজি করে বেড়ায়। যারা এজিএমের জায়গা দখল করে বসে থাকে। টাকা দিলে সব নিয়ম অনিয়ম পাস হয়ে যায়। না দিলে গন্ডগোল। এসব জেনে বুঝে অনেকেই এখন পুঁজিবাজার মুখি হতে আগ্রহী হন না।
(দ্য রিপোর্ট/ মা হা/ টিআইএম/ ১২ জুন,২০২২)